সিউল : স্বর্গ নেমেছে ধরায়

শঙ্কর প্রসাদ দে | সোমবার , ২১ জুলাই, ২০২৫ at ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

থাই এয়ারওয়েজের বিশাল বোয়িং ইনসিওন বিমানবন্দরে নামার মুহূর্তে জানালা দিয়ে কোরীয় উপদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে শুরু হল মুগ্ধতা, বিষ্ময় ও সুখানুভূতির পালা। জুনের ১ম সপ্তাহ বসন্ত বলে কথা। শুনেছিলাম বিমানবন্দরটি পৃথিবী সেরা। প্লেন ল্যান্ডিং, ইমিগ্রেশন ও শহরের দিকে ধাবমান বাসে উঠে বুঝলাম কথাটি সর্বাংশে সত্য। অনেকগুলো ছোট নদীর উপর ডজন খানেক সেতুপথ অতিক্রম করে মিনিট বিশেকের ব্যবধানে সিউল শহরমুখী সর্পিল রাজপথ। দু’পাশে ঘরবাড়ি, তারকাখচিত হোটেল, মোটেল, শপিং মল, আবাসিক এপার্টমেন্টগুলোর চেয়ে সুন্দর হলো প্রবেশাঙ্গন। রাজপথগুলোর দু’ধারে গোলাপসহ বাহারী ফুলবৃক্ষ। মাঝখানে ডিভাইডার সাজানো হয়েছে মাটিভর্তি বাস্কেটে শুধু ফুল, ফুটন্ত ফুল আর ফুলবৃক্ষ। পৃথিবীর সবদেশেই ফুটপাত আছে। অথচ সিউলের ফুটপাত দিয়ে সাইকেল চালানোর জন্য রাবার কার্পেট বিছানো আছে। কোনো ডাস্টবিন নেই। কোনো ধুলাবালি নেই নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া এদেশে কেউ হর্ন বাজায় না। জেব্রাক্রসিং এ যতক্ষণ মানুষ থাকবে ততক্ষণ গাড়ির চাকা ঘুরে না। সিগনাল নেই এমন গলি বা ছোট রাস্তাগুলোতে এটিই নিয়ম এটিই আইন। সন্ধ্যায় দল বেঁধে সবাই বেরোলাম শহর দেখতে। এবার শুরু বিষ্ময়ের চমক। সিনেমা ইউটিউবে দেখে ভাবতাম পশ্চিমা সভ্যতা মানে কি শুধুই নগ্ন বসনা যুবক যুবতীর হৈ হুল্লোড় আর মুক্তঝরানো হাসি? লাইটপোস্ট গুলো কখনো নীল কখনো লাল কখনো হলুদ রং বদলে দেয় বেপরোয়া ষোড়শীদের। দু’আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট, পায়ে হাইহিল স্যু। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে বুঝতে চাইলাম মেয়েগুলোর পরনে হাফপ্যান্ট না অন্তর্বাস। উপরের দিকে ব্রা ছাড়া ব্লাউজের মতো টপস্‌। সিলেটের খাসিয়া মেয়েদের তাজমপিং নামক বক্ষ আবরণী বস্ত্রটি এর’চে অনেক দৃষ্টিনন্দন। রক্তবর্ণ গায়ের রং আর লালচুলা মেয়েগুলোর ঠোঁট পালিশের ফাঁক দিয়ে যখন ধোঁয়া নির্গত হয়, মনে হবে মনুষ্য বিসুভিয়াস। স্বর্গে নাকি অনেক পরী আছে। বিশ্বাস করি স্বর্গ পরীর চেয়ে কোরিয়ান ললনারা অনেক বেশি সুন্দর। মহাভারতের শুরুতে আছে উগ্রতপা ধ্যানমগ্ন দুর্বাশা মুনির সামনে দিয়ে অপ্সরা মেনকা এমন ভাবে গেলেন, চমকে উঠলেন দুর্বাসা, ধ্যানভঙ্গ হলো। জাগতিক নিয়মে জন্ম হলো শকুন্তলার, আজকের কোরিয়ার যত্রতত্র অপ্সরা মেনকার ছড়াছড়ি। জানি না কোরিয়ান গৃহকোণে কতো সহস্র শকুন্তলার জন্ম ও বেড়ে উঠার কাব্যকথা লুকায়িত আছে।

কোরিয়া ভাগ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে। দু’হাজার বছর ধরে পাহাড়ী এই জনপদ ছিল, মূলত জাপানী উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ করেছিল আমেরিকান নৌবাহিনীর হাতে। সেই থেকে আজকের দক্ষিণ কোরিয়া দখলে নিল আমেরিকা। প্রতিষ্ঠিত হলো আজকের দক্ষিণ কোরিয়া। অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর বিষ্ময় মাত্র ১ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের ৫ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ৪৫ হাজার মার্কিন ডলার। ভাবা যায়? এই অর্জন ঘটেছে মাত্র অর্ধশতকে।

১৯৪৫ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত কোরিয়া সংকটের সমাপ্তি হয় ১৯৫৩ সালে উত্তর কোরিয়ার আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপটে। একদিন সবাই মিলে ছুটলাম নামিয়ারা দ্বীপ দেখতে। পৃথিবীর অন্যসব শহরের মতো সিউলের বেড়ে উঠা হাং নদীকে ঘিরে। এই হাং নদীকে ডান পাশে রেখে ট্রেন এগিয়ে চলল নগর পেরিয়ে গ্রামীণ জনপদে। একটিও গাছ কাটা হলো না। একটিও পাহাড় বা টিলা কাটা হলো না। সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রায় দু’শো কিলোমিটার পথ পেছনে ফেললো মাত্র দু’ঘণ্টায়। পাহাড়গুলো দিব্যি মিতালীতে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলায়। বৃক্ষরাজি ব্যস্ত আছে খোশগল্প আর মৃদু কোলাহলে। গ্রামে মানে ২০/২৫ তলা দালান। সমস্ত আধুনিক সুবিধা নিয়ে দালানগুলো দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের ঢালুতে যৎসামান্য ধান গম, ভুট্টো আর সবজি ক্ষেত। নিজের ফসলে ৩ মাসের খোরাকও হয় না। বুঝলাম, একসময় কেন কোরিয়ানরা কুকুর, শুকুর, সাপ, ব্যঙ, পোকামাকড় খেতো। এখনো এসব কোরিয়ানদের জনপ্রিয় খাবার। ধান হয় বলেই পাঞ্চাব আর বাংলার মানুষ ভাত খায়। নইলে আফগানদের মতো আমাদের রুটি খেতে হতো।

সাপ পোকামাকড় খেলে কী হবে? প্রযুক্তিতে এরা এখন বিশ্বসেরা, অর্ধেক মানুষ খৃষ্টান হলেও, এক চতুর্থাংশ বুডিস্ট হলেও, ধর্ম খুব বেশি চর্চিত নয়। এক চতুর্থাংশ মানুষতো কোনো ধর্মই মানে না। বাঙ্গাল কথায় নাস্তিক। অথচ এরা মিথ্যে বলতে জানে না। গত দশকে একমাত্র নারী প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন হাই, বয়ফ্রেন্ড অন্যায়ভাবে সরকারি ফাইল দেখতে দিয়েছিলেন। নৈতিকতার প্রশ্নে তাৎক্ষণিকভাবে শেষ পর্যন্ত অপসারিত হলে বিশ্বের নজরে আসে। অন্যায়ভাবে সামরিক শাসন জারী করায় প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টকে বরখাস্ত করেন। শুধু তাই’ই নয়। প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল সামরিক আইনজারীর জন্য মাফ চেয়েও শাস্তি থেকে রক্ষা পাননি। বলা হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতিতে দঃ কোরিয়া আজকের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক কিছু শেখার আছে। আবার ইনসিওন থেকে টোকিও গামী বিমান আকাশে উড়তেই ভাবলাম মাত্র ৫০ বছরে প্রকৃতিকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না করে, শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ধারণ করে একটি দেশ শহর থেকে গ্রাম অবধি এমন করে সাজাতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর। আনমনে ভাবছিলাম, একটি রাজধানী শহরকেও যে ফুলের বাগানে সজ্জিত করা যায়, বসন্তের সিউল না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। এ যেন স্বর্গ নেমেছে ধরায়।

লেখক: কলামিস্ট; আইনজীবী, আপীল বিভাগ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাইক্রো স্লিপ ড্রাইভিং এ ভয়ংকর অভিজ্ঞতা : সচেতনতা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধসাঈদ বারীর যাপিত জীবন : এক জীবনের আয়নায়, আমাদের সবার মুখচ্ছবি