চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফুসফুস’ খ্যাত ঐতিহাসিক সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ। তারা বলেন, সিআরবিতে হাসপাতাল হলে সবুজের চিহ্ন থাকবে না। ধ্বংস হয়ে যাবে পুরো সিআরবি এলাকা। এমনিতেই অপরিকল্পিত স্থাপনায় ঘিঞ্জি হয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম শহর। তাই পরিবেশ রক্ষায় হাসপাতাল নির্মাণের অপচেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে।
ডা. মাহফুজুর রহমান
একটি প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করার পেছনে বিশেষ কোনো স্বার্থ আছে
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, সিআরবিতে ৫০০ গজের একটা হাসপাতাল নির্মাণের কথা বলে একসময় পুরো এলাকা তারা দখল করে নেবে। আশঙ্কা আছে, সিআরবিকে এখান থেকে সমূলে উৎপাটিত করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার। নয়তো চট্টগ্রামে অনেক জায়গা আছে। যেমন ধরেন, কুমিরায় যে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল আছে, সেটা এখন পরিত্যক্ত। ইচ্ছে করলে সেখানে বিশাল স্থাপনা করতে পারে। এমনিতেই শহরটা ঘিঞ্জি হয়ে যাচ্ছে। একটু পরিবেশ আছে এখানে, তাও নষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার হোস্টেল লাগবে। আরো স্থাপনা গড়ে উঠবে। গোটা সিআরবি পরিণত হবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এজন্য এটা এখানে হতে দেয়া ঠিক হবে না। এখন কেউ যদি গায়ের জোরে হাসপাতাল করে, সেটা আলাদা ব্যাপার। রেলমন্ত্রী বলছেন, যেকোনো মূল্যে হাসপাতাল হবে। কাজেই বোঝা যায়, রেলমন্ত্রীর বিশেষ কোনো স্বার্থ আছে। না হলে প্রাইভেট হাসপাতাল করার জন্য এত তাড়া কেন তাদের? এখানে সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা পাবে না।
ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, আমার কথা হলো, তারা হাসপাতাল করুক। কিন্তু সিআরবিতে কেন? সিআরবিতে একটা হাসপাতাল আছে। ওখানে রেলওয়ের কর্মচারীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা পায়। ওটা আপডেট না করে একটি প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করার চেষ্টার পেছনে নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো স্বার্থ আছে।
অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত
মুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত আছে সিআরবিতে
বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন চট্টগ্রামের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এর ফলে চট্টগ্রামের যে সৌন্দর্য ছিল, তা অনেকাংশে ম্লান হয়ে গেছে। এরপরেও যতটা সৌন্দর্য রয়েছে, তা ধারণ করেছে সিআরবির পাহাড়ি এলাকা। এখানে হাসপাতাল কিংবা অন্য কোনো স্থাপনা নির্মিত হলে সিআরবির সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, সিআরবি এবং সার্সন রোড ছাড়া এমন সবুজ অঞ্চল চট্টগ্রাম শহরে আর নেই। অতএব চট্টগ্রামের নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, এ দুটি অঞ্চলের ক্ষতি করার অধিকার কারো নেই। হাসপাতাল যেটা করতে চাইছে, সেটা যতোটা না সেবামুখী, তার চেয়েও বেশি ব্যবসামুখী। অতএব ব্যবসার জন্য যদি চট্টগ্রামে একটা বদ্ধ পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিঃশ্বাস ফেলবে কোথায়? নিঃশ্বাস গ্রহণ করবে কোথায়? অন্য কোনা জায়গায় তারা করুক।
তিনি বলেন, এখানে কয়েকটি ঐতিহাসিক বিষয় আছে। প্রথমত একাত্তরের পঁচিশে মার্চের তিন দিন আগে সিআরবি পাহাড়ে (ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাংলো যেখানে) মেজর রফিক এবং মেজর জিয়া গাছের তলায় বসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শেষ আলোচনাটা করেছিলেন। এটা রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমের ‘এ টেইল অব মিলিয়ন’ বইয়ে উল্লেখ আছে। মুক্তিযুদ্ধে এ পাহাড়ের অবদান আছে।
দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সময় যে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড, টাকা লুট করে অস্ত্র কেনা; এই রুটটা সেই সময় ব্যবহৃত হতো। আর সিআরবির যে ভবনটা আছে, ব্রিটিশ আমলের তৈরি, তার যে সৌন্দর্য এই স্থাপত্যটা রক্ষা করা দরকার। সবকিছু মিলে বলা যায়, সিআরবিতে সরকার এবং ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে যে উদ্যোগটা নিয়েছে, এ উদ্যোগটা হবে আত্মঘাতী।
ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম
চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা প্রাইভেট সেক্টরকে দেয়াটা হবে আত্মঘাতী
পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রথম কথা হলো আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কেন্দ্রভূমি সিআরবি। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ছিল সিআরবি। এটা একটা গৌরবের বিষয়। সিআরবি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। তাছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে এটা কোনোভাবে প্রাইভেট সেক্টরকে দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, সিআরবিতে রেলওয়ের একটি হাসপাতাল আছে। রেলওয়ে এ হাসপাতালটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারে। অথবা এটা সরকারকে দিতে পারে, যাতে এটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে গড়ে উঠে। আমাদের চট্টগ্রামে বিশেষায়িত কোনো হাসপাতাল নেই। সরকারি ক্যান্সার হাসপাতাল নেই। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল নেই। অর্থোপেডিঙ হাসপাতাল নেই। কিডনি হাসপাতাল নেই। কোনো শিশু হাসপাতাল নেই। এমনকি হৃদরোগের জন্যও কোনো হাসপাতাল নেই। অথচ ঢাকায় বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিট ক্যাপাসিটির তিন চারগুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকে। রোগীর চাপে বিশেষায়িত চিকিৎসাগুলো ব্যাহত হয়। সুতরাং আমাদের বিশেষায়িত হাসপাতালের কোনো বিকল্প নেই।
ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, যে মুহূর্তে এ হাসপাতাল প্রাইভেট সেক্টরে চলে যাবে, সেখানে সাধারণের চিকিৎসার সুযোগ থাকবে না। চিকিৎসা খরচ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। এর আগেও আমরা বেসরকারি খাতে সরকারি জায়গা নামমাত্র মূল্যে দিতে দেখেছি। তাতে জনগণের কি লাভ হয়েছে? বলতে দ্বিধা নেই, অলি আহমেদের সময় এক টাকার বিনিময়ে ইউএসটিসিকে রেলের যে জায়গাটা দিল, সেখানে শর্ত ছিল ১০ পারসেন্ট গরীবের জন্য বরাদ্দ থাকবে। খবর নিয়ে দেখেন প্রতিষ্ঠা থেকে এ পর্যন্ত বিনে পয়সায় কোনো গরীব রোগী ভর্তি করেছে কিনা। কাজেই জায়গা দেয়ার পরে দেখা যায়, এগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
তিনি বলেন, আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে মনে করি, জনগণের সেবা পাওয়ার অধিকার আছে। চট্টগ্রামে নাগরিকদের বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল। এ অবস্থায় চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা প্রাইভেট সেক্টরকে দিয়ে দেয়াটা হবে নাগরিকদের সাথে চরম অন্যায়। দ্বিতীয়ত, সিআরবিকে বলা হচ্ছে নগরীর ফুসফুস। এটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়া যায় না। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে, প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে এটা কোনোভাবে করা যাবে না। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবো।
অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলীম
সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ মানে আমাদের ফুসফুস ধ্বংস করে দেয়া
কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। সিআরবিতে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ হয়, চৈত্র সংক্রান্তি হয়। এটা অসম্ভব সুন্দর প্রাণের মত একটা জায়গা। আমরা ছুটে ছুটে যাই জায়গাটায়। এখানে হাসপাতাল কেন হবে? হাসপাতাল হলে সবুজের চিহ্নও থাকবে না। পুরো সিআরবি এলাকাটা ধ্বংস হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, সিআরবিতে রেলওয়ের যে হাসপাতাল আছে, সেটা ভেঙে আটতলা-দশতলা করুক। পূর্ণাঙ্গ রূপ দিক। কিন্তু নতুন করে হাসপাতাল নির্মাণ করা মানে আমাদের ফুসফুসটা ধ্বংস করে দেয়া। এটা ভাবলেই মনটা কেঁদে উঠছে। এত খানাখন্দ পড়ে আছে, এত পতিত জমি আছে, সেখানে করুক না হাসপাতাল; ঠিক এই জায়গাটাতেই করতে হবে! টার্গেট করতে হবে, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে সবুজ জায়গাটা? এগুলো সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রমূলক ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।