সিআরবি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

২৫ বিশিষ্ট নাগরিকের স্মারকলিপি

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৯ জুলাই, ২০২১ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চট্টগ্রাম মহানগরীর ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সিআরবি এলাকায় সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) প্রস্তাবিত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্প বাতিলের জন্য চট্টগ্রামের ২৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করেছেন। গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও বিশেষ সহকারীর পৃথক ইমেইলে এই স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে বলে প্রতিবাদকারী সংগঠন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার ফ্যাক্স ও ডাকযোগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একই স্মারকলিপি পাঠানো হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসকের মাধ্যমেও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
স্মারকলিপি প্রদানকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন সমাজবিজ্ঞানী আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন, শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফি, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, চবির প্রাক্তন অধ্যাপক চিত্রশিল্পী আবুল মনসুর, সাংবাদিক ও কবি আবুল মোমেন, মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও চসিকের প্রাক্তন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মফিজুর রহমান, নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম, কথাসাহিত্যিক অধ্যাপিকা ফেরদৌস আরা আলীম, শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সভাপতি আলহাজ্ব আলী আব্বাস, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ সম্পাদক রুশো মাহমুদ, দৈনিক পূর্বদেশ সম্পাদক মুজিবুর রহমান সিআইপি, দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ সম্পাদক সৈয়দ উমর ফারুক, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ, বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুস, কবি, কলামিস্ট কামরুল হাসান বাদল এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন।
স্মারকলিপিতে তাঁরা উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম বিশ্বের প্রাচীনতম একটি নগর বন্দর। প্রখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলো, ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম ভ্রমণ করে এই নগরের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করে গেছেন। পাহাড়, সমুদ্র ও নদী বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি চট্টগ্রাম মহানগরী বহুকাল ধরে প্রাচ্যের রাণী হিসেবে খ্যাত। দুঃখের ব্যাপার, এই নগরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই শহরে এক সময় অনেক পাহাড়, দীঘি ও পুকুর ছিল, ছিল শাল, রেইনট্রি ইত্যাদি বৃক্ষ আচ্ছাদিত রাস্তা, ছিল বাটালি হিল এবং ফেয়ারি হিল বা কাচারি পাহাড়। বাটালি হিল পাকিস্তান আমলেই ধ্বংস করা হয়েছে। কাচারি পাহাড়ের উপরও আঘাত হেনেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার, যখন এই পাহাড়ের পাদদেশের বিশাল অংশ কেটে তৈরি করা হয় নিউ মার্কেট, জেনারেল পোস্ট অফিস ও স্টেট ব্যাংক। এক সময় কাচারি পাহাড় এবং কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত সদরঘাট ব্রিজ ছিল প্রকৃতিপ্রেমী চট্টগ্রামবাসীর বেড়ানোর জায়গা, ক্লান্তি অপসারণের জায়গা। আজ সদরঘাট ব্রিজের কথা দূষিত কর্ণফুলীর কারণে মানুষ ভুলে গেছে। দুই দশক আগেও কাচারি পাহাড়ে ভ্রমণ পিয়াসীরা বেড়াতে গেলে দেখতে পেতেন কর্ণফুলী নদী কী অবর্ণনীয় সুন্দরভাবে চট্টগ্রাম শহরকে ‘মেখলা’ বা ‘মালার মতো’ বেষ্টন করে রয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতি এবং মানুষের লোভের আঘাতে আজ প্রকৃতির অপরূপ এসব দান তিরোহিত। কেবলমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে মহানগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি। শতবর্ষী বৃক্ষরাজি পাহাড়, টিলা ও উপত্যকায় ঘেরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি অনন্য প্রাকৃতিক স্থান এই সিআরবি।
তাঁরা বলেন, বর্তমানে প্রকৃতির অসীম দানে-ঋদ্ধ এরকম বড় উন্মুক্ত স্থান চট্টগ্রামে আর নেই, যেখানে ঢাকায় রয়েছে রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাহাদুর পার্কসহ বৃক্ষ-শোভিত বহু উন্মুক্ত অঞ্চল ও বহু খেলার মাঠ। চট্টগ্রামের এই সিআরবির উন্মুক্ত স্থানেই এখন আয়োজিত হয় বাংলা নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী, নজরুল জন্মবার্ষিকী ও বাঙালির অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এক সময় বাঙালির প্রাণের এই অনুষ্ঠানগুলো উদযাপিত হতো ডিসি হিলে, সার্কিট হাউজের সামনের উন্মুক্ত স্থানে যা এখন জিয়া শিশু পার্ক এবং আউটার স্টেডিয়ামে যা এখন একটি বিশাল কংক্রিট আচ্ছাদিত সুইমিংপুল ও বিপণী কেন্দ্র।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বিবৃতিদাতাগণ বলেন, আপনার প্রকৃতি প্রেম, প্রকৃতি বান্ধবতা বিশ্ববিদিত। ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল ‘লিডার্স সামিট অন ক্লাইমেট’- এ প্রকৃতি নিয়ে যে ৪০ জন বিশ্ব নেতা বক্তব্য রেখেছেন সেখানে আপনি কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের মাধ্যমে বিশ্বের প্রাকৃতিক উষ্ণতা যেন বর্তমান পর্যায় থেকে দেড় শতাংশের বেশি না বাড়ে তা দাবি করে যে আহ্বান জানিয়েছেন তা বিশ্ব নন্দিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, আপনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবমোকাবেলায় দীর্ঘকাল ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই উদ্যোগেরই অংশ হিসেবে আপনার নেতৃত্বে আজ যেখানে বাংলাদেশ জুড়ে বিপুলভাবে বৃক্ষ রোপনের বিরাট উদ্যোগ শুরু হয়েছে, সেখানে বোটানিকাল গার্ডেনের মতো বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য শতবর্ষী বৃক্ষরাজি শোভিত চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি এলাকায় যদি বিত্তবানদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য একটি মুনাফাভিত্তিক বেসরকারি হাসপাতাল নির্মিত হয় তার চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কী হতে পারে! তাই, চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের আপনার কাছে ঐকান্তিক আবেদন, চট্টগ্রামের এই অপরূপ প্রকৃতি-ঋদ্ধ সিআরবি এলাকাটিকে রক্ষা করুন। তাঁরা আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমরা আরো জেনেছি, উল্লেখিত হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০১৭ সালে আহূত ইনভাইটেশন ফর বিড (আইএফবি) নোটিশে প্রকল্পের স্থান হিসেবে সিআরবির নাম ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৪ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতি নিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এছাড়াও মাস্টার প্ল্যানের আলোকে ২০০৯ সালে সিডিএ কর্তৃক প্রণীত ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)’ এ সিআরবিকে ‘সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’ হিসেবে সংরক্ষণের কথা উল্লেখ আছে। আমরা আশা করি, সরকারি জায়গায় যদি কোন বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণ করা হয় তা যেন প্রকৃত অর্থেই জনকল্যাণমূলক হয়, মুনাফাভিত্তিক নয়। বিবৃতিদাগণ জানান, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদ হিসেবে আত্মোৎসর্গ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭১ সালের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শহীদ আব্দুর রব। তাঁর এবং আরো ৮ জন শহীদের সমাধিস্থল এই সিআরবি এলাকা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান এসব বীর শহীদদের গৌরব স্মৃতি এখানে অম্লান ও অক্ষুণ্ন থাকুক এই আমাদের কামনা।
প্রধানমন্ত্রী, আপনার অসাধারণ নেতৃত্বে চট্টগ্রাম আজ ভৌত অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিপুলভাবে এগিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নির্মিত হয়েছে ফ্লাইওভার, কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে মীরসরাই পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে বে ভিউ হাইওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি করা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল- বঙ্গবন্ধু টানেল। কিন্তু এসব মহতী অর্জন সত্ত্বেও চট্টগ্রাম শহর আজ পরিণত হয়েছে ‘ইটের পরে ইট’ বিশিষ্ট একটি নগরীতে। এখানে শিশু কিশোরদের খেলার জন্য কোন মাঠ নেই, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের জন্য নেই কোন হাঁটার জায়গা, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ক্লান্তি থেকে মুক্তির জন্য নেই কোন বেড়ানোর উন্মুক্ত স্থান, কেবলমাত্র সিআরবি ছাড়া। অসংখ্য বৃক্ষরাজি শোভিত এই নগরটি আজ প্রায় বৃক্ষহীন। সভ্যতার অগ্রগতি একদিকে এই শহরটিকে করেছে চাকচিক্যময়, অন্যদিকে প্রকৃতির দাক্ষিণ্যহীন প্রাণহীন নগর। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে আমরা আকুল আবেদন জানাচ্ছি, চট্টগ্রামের শেষ প্রকৃতি-ঋদ্ধ স্থান সিআরবিকে রক্ষা করুন। আপনার মহতী নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি মানবিক, পরিবেশ সমৃদ্ধ উন্নত দেশে পরিণত হোক, এই কামনা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিআরবি রক্ষায় আমরণ অনশনের ঘোষণা অনুপম সেনের
পরবর্তী নিবন্ধ১৭ স্লুইচ গেট চালু না হওয়া পর্যন্ত মিলবে না সুফল