ছাত্রদলের চট্টগ্রাম মহানগর সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ৩৫ সদস্যের কমিটিতে মো. সাইফুল আলমকে আহ্বায়ক ও শরীফুল ইসলাম তুহিনকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এছাড়া ১৯ জন যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ১৪ জনকে সদস্য করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গত শনিবার রাতে কমিটির অনুমোদন দেন। কিন্তু তা জানাজানি হয় রাত চারটার দিকে। দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর (সাত বছর পাঁচ মাস) পর ঘোষিত কমিটিকে ঘিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে পদবঞ্চিতরা নবগঠিত কমিটি প্রত্যাখান করে গতকাল বিকেলে বিক্ষোভ করেছেন। কাজীর দেউড়ি থেকে নাসিমন ভবনস্থ দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত তারা মিছিল করেন। পরে দলীয় কার্যালয়ের সামনে পরপর চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে আতংক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এসময় টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দেন ক্ষুব্ধ ছাত্রদল কর্মীরা। পরে পুলিশ আসলে পালিয়ে যান তারা। তবে ঘটনাস্থল থেকে নগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি শফিউল আলমকে আটকের পাশাপাশি দুইটি অবিস্ফোরিত ককটেল ও তিনটির অংশ বিশেষ উদ্ধার করা হয় বলে জানায় পুলিশ। এদিকে ক্ষুব্ধ ছাত্রদল কর্মীরা দাবি করেছেন, রাতের আধারে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মাধ্যমে লেনদেন করে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হয়নি। তারা বলছেন, ঘোষিত কমিটির সদস্য সচিবসহ ১৩ জন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলালের অনুসারী। যিনি উত্তর জেলার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। অথচ নগর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান এবং নগরের আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনের হাতেগোনা কর্মী স্থান পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়েও ক্ষোভ আছে নগর বিএনপির র্শীষ নেতাদের অনুসারীদের মাঝে।
আনন্দ মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জ : গতকাল সকালে দলীয় কার্যালয়ের সামনে নূর আহম্মদ সড়কে আনন্দ মিছিল বের করেন ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির নেতৃবৃন্দ। এসময় ব্যানারের সামনে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে সদস্য সচিব শরীফুল ইসলাম তুহিন বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এনায়েত বাজার ওয়ার্ড ছাত্রদলের এক নেতার সাথে। এসময় ‘বিশৃঙ্খলা’ দেখা দিলে পুুলিশ লাঠিচার্জ করে। এতে ছয়জন আহত হয়। এছাড়া গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। আহতরা হচ্ছেন- যুগ্ম আহ্বায়ক আসিফ চৌধুরী লিমন, মাহমুদুর রহমান বাবু, মোহাম্মদ আনাছ, রাজিবুল হক বাপ্পী, মো. ইসমাইল হোসেন ও শহীদ। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছেন, মোজাম্মেল হক মনজু, তৌহিদুল ইসলাম শিপন ও মনিরুজ্জামান সায়ান।
পুলিশের বক্তব্য : কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে দিনভর দুইপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। সকালে নিজেরা নিজেরা সংঘর্ষ করেছে এবং বিকেলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। সকালের ঘটনায় তিনজন এবং বিকেলের ঘটনায় একজনকে আটক করেছি। বিকেলে দুইটা অবিস্ফোরিত ককটেল এবং বিস্ফোরিত তিনটার অংশ বিশেষ উদ্ধার করেছি। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
নতুন নেতৃত্বের বক্তব্য : নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক মো. সাইফুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা কাজীর দেউড়ি অ্যাপোলো শপিং কমপ্লেঙের সামনে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে আনন্দ মিছিল করে পার্টি অফিসে আসি। সেখানে সভা করছিলাম। শেষ পর্যায়ে আকস্মিকভাবে পুলিশ ঢুকে লাঠিচার্জ করতে থাকে। এসময় আমাদের ছয়জন আহত হয় এবং পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। দুই গ্রুপের সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো সংর্ঘষ হয় নি।
পদবঞ্চিতদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে রাতের আঁধারে কমিটি ঘোষণার দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন আছেন লন্ডনে। বাংলাদেশে রাত হলে ওখানে দিন। কাজেই উনি দেখে-শুনে কমিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন তখন এখানে রাত হতেই পারে। তবে রাতদিন কোনো বিষয় না। কমিটি হয়েছে সেটাই বড় কথা। সবাইকে সাথে নিয়ে কেন্দ্রের নির্দেশিত সময়ে অধীনস্থ ইউনিট কমিটিগুলো গঠন করবো।
পদবঞ্চিতদের বক্তব্য : পদবঞ্চিত আলাউদ্দিন আলো দৈনিক আজাদীকে বলেন, যাদের ছাত্রত্ব আছে, রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন তাদেরকে দিয়ে কমিটি করার কথা ছিল। কিন্তু গঠিত কমিটির ১০-১২ জন ছাড়া বাকিরা রাজপথে ছিল না। গত ১৩ বছর ধরে রাজনীতি করছি কিন্তু কমিটিতে আসা ২০-২৫ জনকে আমরা চিনিও না। কারণ তারা মাঠে ছিল না। তাদের সঙ্গে কারো যোগাযোগ ছিল না। কোনো এক নেতার ইশারায় তারা কমিটিতে স্থান পেয়েছে। এটা আমরা কিভাবে মেনে নিব। তাই এ কমিটির প্রতি আমরা অনাস্থা প্রকাশ করছি এবং আমাদের দাবির বিষয়টি কেন্দ্রকে জানানোর জন্য বিক্ষোভ করেছি।
ক্ষুব্ধ জাফরুল হাসান রানা দৈনিক আজাদীকে বলেন, নগর বিএনপির আহ্বায়ক-সদস্য সচিবের সাথে আলোচনা না করেই রাতের আঁধারে কমিটি করা হয়েছে। পছন্দের ছেলেদের স্থান দিতে গিয়ে মাঠে ছিল এমন অনেককে কমিটিতে রাখা হয়নি। যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই ক্ষুব্ধ ছাত্রদল কর্মীরা বিক্ষোভ করেছে। যারা বাদ পড়েছে তাদেরকে মূল্যায়ন করা হোক। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেখানে নগর বিএনপির সিনিয়র নেতারা কমিটির বিষয়ে অবগত ছিলেন না সেখানে তো বুঝাই যায় কোন উপায়ে কমিটি হয়েছে।
বিএনপি নেতারা যা বলছেন : নগর বিএনপি’র আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, কমিটি হয়েছে সেটা সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশ। কিন্তু যারা এসেছে তাদের অনেকের চেয়েও অ্যাক্টিভ ১৫-২০ জন ছেলেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ তারা দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিল। দলের জন্য তাদের অনেক ত্যাগ আছে। এদের সম্পৃক্ত করে কমিটি করলে সেটা অনেক বেশি সুন্দর হতো। তারপরও যে কমিটি হয়েছে তাদের নগর বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো। আশা করছি সবাইকে সাথে নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তারা দলের জন্য কাজ করবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মাঠে থাকবে।
কমিটি ঘোষণার আগে নগর বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কোনো আলাপ করে নি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কমিটি দিবে এমন কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু হুট করে দিবে সেটা জানতাম না। রাত চারটার দিকেই দেখলাম কমিটি হয়েছে। যদি আলাপ করতো তাহলে যারা বাদ পড়েছে তাদের বিষয়ে বলতে পারতাম। অবশ্য আগে তারা যখন আমার কাছে নাম চেয়েছিল তখন তালিকা দিয়েছিলাম। যারা বাদ পড়েছে তাদের নাম সেখানে সম্পৃক্ত ছিল।
নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর দৈনিক আজাদীকে বলেন, ছোট কমিটি। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সবাইকে অনেক সময় রাখা সম্ভব না। তবে কমিটি তো পূর্ণাঙ্গ হবে। আশা করছি। সেখানে সবাইকে রাখা হবে।
কমিটিতে যারা আছেন : নতুন কমিটির নেতৃবৃন্দকে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে তাদের অধীনস্ত সকল ইউনিট চট্টগ্রাম বিভাগীয় টিমের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে গঠন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের কাছে পাঠানোর নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
কমিটির যুগ্ম আহ্বায়করা হচ্ছেন- এইচএমএম আসিফ চৌধুরী লিমন, তারিকুল ইসলাম তানভীর, মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন সাহেদ, মো. সামিয়াত আমিন চৌধুরী জিসান, জিএম সালাহ উদ্দিন কাদের আসাদ, মো. আরিফুর রহমান প্রকাশ মাস্টার আরিফ, জহির উদ্দীন বাবর, মোহাম্মদ আরিফুর রহমান মিঠু, শহিদুল ইসলাম সুমন, মো. সাব্বির আহমেদ, এমএ হাসান বাপ্পা, মো. রাজিবুল হক বাপ্পী, মো. মাহামুদুর রহমান বাবু, মো. ইসমাইল হোসেন, মোহাম্মদ আনাছ, মো. জাহেদ হোসেন খাঁন জসি, মো. নূর নবী মহররম, নূর জাফর নাঈম রাহুল ও মো. ফখরুল ইসলাম শাহীন।
সদস্যরা হচ্ছেন- মো. নজরুল ইসলাম, মো. শামসুদ্দীন শামসু, ইমরান হোসেন বাপ্পী, মো. আবু কাউসার, শাহরিয়ার আহমেদ, আল মামুন সাদ্দাম, দেলোয়ার হোসেন শিশির, তারেক আজিজ বিপ্লব, মাহামুদুল হাসান রাজু, মো. কামরুল হাসান আকাশ, মো. এনামুল হক, আবুল হাসনাত জুয়েল, মো. আব্বাস উদ্দিন, রকি হোসেন পিচ্চি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২১ জুলাই নগর ছাত্রদলের ১১ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। গত ৩০ নভেম্বর তা ২৭২ এবং গত সপ্তাহে ৫৮৩ সদস্যে উন্নীত করা হয়। গতকাল বিশাল সাইজের এ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।