যমুনা অয়েল কোম্পানির পতেঙ্গা ডিপো থেকে দেড় লাখ লিটার তেল চুরির ঘটনার প্রায় তিন বছর ৭ মাস পর শাস্তির আওতায় এসেছে জড়িতরা। গত ২৯ এপ্রিল যমুনা অয়েল কোম্পানির এক ভার্চুয়াল বোর্ড সভায় ঘটনায় জড়িত ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে ৬ মে ওই ৬ কর্মকর্তাদের শাস্তির বিষয়ে চিঠিও ইস্যু করে প্রতিষ্ঠানটি। ৬ কর্মকর্তার মধ্যে এজিএম (টার্মিনাল) নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদ ও এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (অপারেশন্স) আবদুর রাজ্জাককে স্থায়ী বরখাস্ত করা হয়েছে। একইসাথে আর্থিক ক্ষতির দায়দায়িত্ব নিরূপণ ও হার নির্ধারণ কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে এই দুজনের কাছ থেকে ৩০ লক্ষ ৮৫ হাজার ৭৫৬ দশমিক ২৭ টাকা করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। ওই তেল চুরির অভিযোগ উঠার পর থেকে তারা সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। তাদের সাথে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (অপারেশন) প্রিয়তোষ নন্দীকে কাজে যোগদানের আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে তাকেও ক্ষতিপূরণের ১৮ লক্ষ ৯৮ হাজার ৯২৭ দশমিক ৭৮ টাকা পরিশোধ করতে হবে। পাশাপাশি তার প্রাপ্য তিনটি ইনক্রিমেন্টও স্থগিত করা হয়। তার মত সিনিয়র অফিসার (অপারেশন্স) সমীর কুমার পাল থেকেও ৯ লক্ষ ৪৯ হাজার ৪৬৪ দশমিক ৩৮ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায়সহ তার প্রাপ্য দুইটি ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়। এই ঘটনায় সিনিয়র অফিসার (অপারেশন্স) নুরুল আলম ও ম্যানেজার (অপারেশন) মো. জাহিদ মুরাদকে ঘটনার বিষয়ে শোকজ করার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রসঙ্গত, যমুনা অয়েল কোম্পানির পতেঙ্গা ডিপোতে তেল চুরির অভিযোগ উঠায় ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর ‘ডিপ বুক ও লোডিং স্লিপে গরমিল; যমুনার ডিপো থেকে কোটি টাকার জ্বালানি গায়েব’ শীর্ষক প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক আজাদী।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর যমুনা অয়েলের গুপ্তখাল ডিপো থেকে এমটি রায়দা ও এমটি মনোয়ারা নামের দুই জাহাজে তেল পাচারের অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে ২ নভেম্বর আজাদীতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে টনক নড়ে প্রতিষ্ঠানটির। এরপর ৫ নভেম্বর খুলনার ভৈরত নদীতে চোরাই তেল বিক্রির সময় হাতেনাতে এমটি রায়দাকে আটক করে র্যাব। তখন ওই এমটি রায়দায় কর্মরত ১৪ জনসহ চোরাই তেলের এক ক্রেতাকেও আটক করা হয়।
ওইদিনই ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরের দিন ৬ নভেম্বর যমুনা অয়েল চট্টগ্রামের প্রধান ডিপো পতেঙ্গা ইনচার্জ এজিএম (টার্মিনাল) নুরুদ্দিন আহমেদ আল মাসুদ, ম্যানেজার (অপারেশন) মো. জাহিদ মুরাদ এবং এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (অপারেশন) প্রিয়তোষ নন্দীকে প্রত্যাহার করে প্রধান কার্যালয়ে বদলী করা হয়।
এর পরের দিন ৭ নভেম্বর রাতে চোরাই তেল পাচারের ঘটনায় আটক ১৪ জন ও যমুনা অয়েলের পতেঙ্গা ডিপোর তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে আসামি করে খুলনার দিঘলিয়া থানায় মামলা দায়ের করা হয়। র্যাব বাদী হয়ে মামলা করলেও চুরি যাওয়া এসব জ্বালানির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসি ও যমুনা অয়েল ওই ঘটনায় ফৌজদারি মামলা করেনি। পরবর্তীতে র্যাবের ওই মামলাতেও পক্ষভুক্ত হয়নি বিপিসি। ঘটনা জানাজানি হলে জড়িতরা দালিলিক কাগজগুলো ঘষামাজা, কাটাছেঁড়া করে একই ঘটনায় দুইটি ডেসপাস স্টেটম্যান এবং দুটি প্রোডাক্ট ট্রান্সফার অর্ডার (পিটিও) বানায়। পরবর্তীতে যমুনা অয়েলের তদন্ত রিপোর্টেও ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রায় সব ডকুমেন্টে ঘষামাজা, কাটাছেঁড়া ও ফ্লুইট ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
এদিকে প্রাথমিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। বিভাগীয় মামলায় নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদ, প্রিয়তোষ নন্দী, সমীর কুমার পাল, আবদুর রাজ্জাকসহ এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (অপারেশন্স) গোলাম কিবরিয়াকে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়। এরপর ৫ কর্মকর্তার জবাব কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ডিজিএম (এমআইএস এন্ড আইটি) মাসুদ করিমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ওই ঘটনায় বিভাগীয় মামলায় অভিযুক্ত পাঁচ কর্মকর্তার মধ্যে শুধুমাত্র গোলাম কিবরিয়ার সম্পৃক্ততা না পেলেও সাবেক ম্যানেজার (অপারেশন্স) জাহেদ মুরাদ ও সিনিয়র অফিসার (অপারেশন্স) নুরুল আলমের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায়। প্রায় ৫ মাস তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ৩ জুলাই যমুনা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। বিভাগীয় তদন্ত কমিটি পরিদর্শনে গিয়ে এমটি রায়দা জাহাজ লোডের আলাদা দুটি পিটিও (প্রোডাক্ট ট্রান্সফার অর্ডার নং- ১৪১০১৭১০০০৯৫ এর স্থলে ১৪১০১৭১০০০৯৭) উপস্থাপনেরও প্রমাণ পান।
বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) আইয়ুব হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট ‘আর্থিক ক্ষতির দায়দায়িত্ব নিরূপণ ও হার নির্ধারণ কমিটি’ গঠন করে যমুনা অয়েল কোম্পানি। ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে জমা দেওয়া আর্থিক ক্ষতির দায়দায়িত্ব নিরূপণ ও হার নির্ধারণ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী গায়েব হওয়া এক লাখ ৫১ হাজার ৮৯০ লিটার ডিজেলের মূল্য ৯৪ লক্ষ ৯৪ হাজার ৯৪৩ টাকা নির্ধারণ করে দোষী ৫ কর্মকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আদায়ের সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে দোষীদের বিরুদ্ধে চাকুরি বিধি মোতাবেক পেনাল্টি, পানিশমেন্ট প্রদানের জন্যে সুপারিশ করেন আর্থিক ক্ষতির দায়দায়িত্ব নিরূপণ ও হার নির্ধারণ কমিটি।
এ ব্যাপারে যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনচারী শনিবার দুপুরে দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেড় লক্ষ লিটার তেল চুরির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে দুইজনকে ডিসমিস করা হয়েছে। অন্যদের কাছ থেকেও ক্ষতিপূরণ আদায়, ইনক্রিমেন্ট স্থগিতসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের নামে চিঠিও ইস্যু করা হয়েছে।