এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে থেকেই বাংলাদেশ দলের অবস্থা ছিল হতশ্রী। বিশ্বকাপের ভেন্যু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টি–টোয়েন্টি সিরিজ হারের পর বিশ্বকাপের মূল পর্বে কেমন করে বাংলাদেশ তা নিয়ে ছিল শংকা। যদিও গ্রুপ পর্বে শ্রীলংকাকে হারিয়ে শুরু করে টাইগাররা বিশ্বকাপ মিশন। পরের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও জিততে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবিয়ে ফিরে সে ম্যাচে।
অবশ্য পরের দুই ম্যাচে জিতে ঠিকই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সুপার এইট পর্বে জায়গা করে নিয়েছিল। আর সে পর্বের বাংলাদেশ যেন ফিরে গেল দুই দশক আগের বাংলাদেশে। ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপই শেষ হয়ে যায় টাইগারদের। কিন্তু কথায় আছে না কপালে থাকলে ঠেকায় কে? আবার কপালে থাকলেও সেটা তুলে নিতে সর্বস্ব দিতে হয়। বাংলাদেশের সামনে কপাল গুনে সেমিফাইনালে যাওয়ার একটি সুযোগ এসেছিল। কিন্তু হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলার মত সে সুযোগকে হেলায় হারিয়ে ফেলল বাংলাদেশ।
প্রথমবারের মত টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইতিহাস সৃষ্টি করাটা মোটেও কঠিন কাজ ছিল না। শেষ চারের সে দৌড়ে বাংলাদেশকে দারুণভাবে রেখেছিল দলের বোলাররা। যে আফগান উদ্বোধনী জুটি এই বিশ্বকাপের তিন ম্যাচেই শতরানের বেশি জুটি গড়েছে সেই গুরবাজ আর ইব্রাহিমকে থামিয়েছিলেন ৫৯ রানে। দলটির মিডল অর্ডারকে মোটেও চড়াও হতে দেননি রিশাদ, তাসকিন, মোস্তাফিজরা। আফগানিস্তানের মতো দলকে মাত্র ১১৫ রানে থামিয়ে দেওয়ার পুরো কৃতিত্ব বোলারদের। অথচ ব্যাটাররা কি করল? বর্তমানে টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিয়মিতই দুইশর বেশি রান হয়। আবার সে রান তাড়াও হয়। অথচ বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্যটা মাত্র ১১৬ রানের। আর সেটা করতে হবে ১২.১ ওভারে। যা মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয়। হোক না আফগানিস্তান দলে রয়েছে বিশ্বের সেরা সব বোলার। কিন্তু চাপটা যে তাদের উপরই।
বাংলাদেশ দলের যে এই ম্যাচে হারানোর কিছুই নেই। কারণ এই ম্যাচে ২০ ওভার খেলে জিতলে যেমন আউট তেমনি হেরে গেলেও আউট। তাই একটি ইতিহাসের অংশ হতে লড়াই করতে দোষ কি? কিন্তু সে মানসিকতা দেখা গেল না টাইগার ব্যাটারদের। শুরু দিকে লিটনের ব্যাটিং তেমন ইঙ্গিত দিলেও পরে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে মানসিকতা। যদিও দলের অধিনায়ত নাজমুল হোসেন শান্ত ম্যাচ শেষে বলেছেন তারা শুরুতে সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য লড়াই করতে নেমেছিল। কিন্তু পরে তিন উইকেট পড়ে গেলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জয়ের লক্ষ্য নিয়ে এগুতে থাকে। আর তাতেই সব হারাল বাংলাদেশ। কোন কিছুই পাওয়া হলো না। উল্টো আফগানিস্তান চলে গেল সেমিফাইনালে। ম্যাচে একাধিকবার বৃষ্টি হানা দেওয়ায় এক পর্যায়ে লক্ষ্যটা দাড়িয়েছিল ১৯ ওভারে ১১৪ রান। কিন্তু সেটাও শেষ পর্যন্ত তুলে নিতে পারেনি বাংলাদেশের ব্যাটাররা। ডিএলএস মেথডে ৮ রানে হেরে নিজেদেরতো বটেই সে সাথে অস্ট্রেলিয়ারও স্বপ্ন ভঙ্গ করে দিল বাংলাদেশ দল।
বাংলাদেশ দল নিজেদের উপর ভরসা রাখতে পারেনি। যারা নিজেদের উপর ভরসা রাখতে পারে না তারা কিভাবে এত বড় লক্ষ্য অর্জন করবে। বাংলাদেশ দলের ওপেনার লিটন দাশ আর তাওহিদ হৃদয় ছাড়া আর কোনো ব্যাটারকে দেখা গেল না আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে ব্যাট করতে। মাহমুদউল্লাহতো আফগান স্পিনার নুর আহমেদের বলে ৫টি ডট বল খেললেন। আর তখনইতো পরিষ্কার কি পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ দলের। খেলব কি খেলবনা, যাব কি যাবনা, এই ভেবে ভেবেই যেন শেষ বাংলাদেশ দল। অথচ এমন সুযোগ আর কবে আসবে সেটা বলাও মুশকিল। আফগানিস্তান নিজেদের পরিকল্পনায় একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল অটল। কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই। আর তা হচ্ছে ম্যাচ তাদের জিততেই হবে। আর সে জেতার জন্য যা যা করার সবই করেছে রশিদ খানের দল। বাংলাদেশ সেখানে পরিকল্পনায় স্থির থাকতে পারেনি। পুরো ম্যাচ জুড়ে বেশ কিছু ছবি পরিষ্কার হয়ে গেছে টিভির কল্যাণে। তা হচ্ছে এমন স্নায়ু চাপের ম্যাচে যেখানে আফগান কোচিং স্টাফরা পারছিলনা নিজেরা মাঠে নেমে খেলে দিতে। সেখানে বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ কিংবা সিনিয়র ক্রিকেটার বা টিম ম্যানেজম্যান্ট সবাই একেবারে নির্ভার হয়ে বসেছিলেন ডাক আউটে। ক্রিকেটারদের সাহস যোগাতে দ্বাদশ খেলোয়াড়কেও তেমন মাঠে প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। এই যদি হয় অবস্থা তখন কোন কিছু আর বুঝতে বাকি থাকে না বাংলাদেশ পরিকল্পনায় কতটা অপরিপক্ক ছিল। এমন অপরিপক্ক পরিকল্পনা নিয়ে আর যাই হোন অন্তত ক্রিকেট ম্যাচ জেতা যায় না তা প্রমাণ করে দিল বাংলাদেশ।
ক্রিকেটের বাস্তবতায় যত ভালো বোলার হোকনা কেন ওভারে একটি বা দুটি খারাপ বল করবেই। আবার সে সংখ্যাটা বেশিও হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ দলের ব্যাটারদের ব্যাটিং এর ধরন মোটেও ম্যাচ জয়ের অনুকূলে ছিল না। তানজিদ তামিম যে বলটাতে আউট হলেন ক্রস খেলে তা মোটেও প্রয়োজন ছিল না। অধিনায়ক শান্তর জন্য এই ম্যাচটা হতে পারতো অনেক কিছু অর্জনের। কিন্তু নাবীন উল হকের স্লোয়ার ডেলিভারিটা তিনি যেভাবে সীমানা পার করতে চাইলেন তা কখনোই হতে পারে না। আর সাকিব? ইয়র্কার লেন্থের বলটা তিনি কোনদিকে খেলতে গেলেন? অন সাইডে নাকি অফ সাইডে? নায়ক হতে পারতেন সৌম্য সরকারও। কিন্তু লক্ষ্য ছিল না তিনি কি করবেন।
একমাত্র তাওহিদ হৃদয় ছিলেন সত্যিকারের পরিকল্পনায়। হয় ছক্কা নয় অক্কা সে পথেই হেঁটেছিলেন এই তরুণ। ফিনিশার মাহমুদ উল্লাহ নুর আহমেদের এক ওভারে দিলেন পাঁচটা ডট বল। দলের শীর্ষ ব্যাটারদের যখন এই অবস্থা তখন রিশাদ, তানজিম সাকিব, তাসকিন আর মোস্তাফিজদের কিইবা করার থাকে। বেচারা লিটন দাশ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উইকেটে অজেয় থেকেও ফিরতে হলো পরাজয় নিয়ে। পুরো বাংলাদেশের চিত্রটা এমনই খন্ড খন্ড চিত্রনাট্যে ভরা। যেখানে দিন শেষে পরাজিত দল বাংলাদেশ। আর সেটাও একেবারে হাতের লক্ষি পায়ে ঠেলে।