: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- ২৭ মার্চের প্রথম অধিবেশন এবং একটি ক্যাসেট…।
: সেদিন সকাল ১০ টায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা চান্দগাঁও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়েছিলেন যুদ্ধের কথা, প্রতিরোধের কথা, দেশবাসিকে জানাতে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কন্ট্রোল কক্ষ থেকে তারা গিয়েছিলেন। সেদিন ছাত্রনেতারা কি বলেছিলেন, কি তাঁদের নির্দেশনা ছিলো, জনগণের প্রতি তাদের কি ম্যাসেজ ছিলো তা এতোদিন জেনেছি অন্যরকম বা ভাসা ভাসা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে। চেয়ারম্যান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান এবং মহাসচিব ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম। তাঁদের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম একেবার তৃণমূলে পৌঁছে যায়। আবিষ্কৃত হতে থাকে নতুন নতুন তথ্য, যার মাধ্যমে গবেষণার দুয়ার খুলে যায়। আমরা জেনেছি ২৭ মার্চ সকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশ বেতারে একটি অনুষ্ঠান করেছিলো। আমরা বলেছি ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম অধিবেশন হয়েছিলেন বেলা ২.১০ মিনিটে। এই অধিবেশনে ছাত্রনেতা রাখাল চন্দ্র বণিক এর উপস্থাপনায় এম.এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে রেডিও কর্মীদের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধিবেশন পরিচালিত হয়েছিলো এবং রাত ১০ টায় ইংরেজি অনুষ্ঠান হ্যালো ম্যানকাইন্ড প্রচারিত হয়েছিলো বেতারের তৃতীয় অধিবেশনে। আবার ২৭ মার্চ সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠান করেছিলো ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীন বাংলার বেতারের প্রথম অধিবেশন এবং ২৭ মার্চের প্রথম অধিবেশনের তথা বিখ্যাত লেখকদের কেউ কেউ স্বীকার করেননি। এখানে বলা প্রয়োজন যে ২৭ মার্চের প্রথম অধিবেশন তথা স্বাধীন বাংলা বেতারের ৪র্থ অধিবেশনের একটি ক্যাসেট অবিষ্কৃত হয়েছে। এই ক্যাসেট মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পূর্বের অনেক কথা এখন আমাদের সামনে স্পষ্ট। সেই ক্যাসেট থেকে কিছু কথা এখানে উপস্থাপন প্রয়োজন। কারণ যারা এতোদিন সত্য স্বীকার করেননি বা ইচ্ছা করে ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে, ইতিহাসকে মিথ্যা পথে পরিচালনা করে চাপিয়ে রাখা যায় না। সত্য প্রকাশ পাবেই। কি আছে এই ক্যাসেটে! প্রমাণিত সত্য হচ্ছে,
১. স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম বাংলা সংবাদ পাঠক ছিলেন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছেন,
* বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন গোপন স্থান থেকে।
* বীরযোদ্ধারা টিক্কা খানকে হত্যা করেছে।
* প্রতিরোধ চলছে সর্বত্র, প্রতিজন বাঙালিকে যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান।
* ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দিকে অসছে বাঙালিদের সমর্থনে।
এই বাংলা সংবাদের ইংরেজি অনুকরণে প্রথম ইংরেজি সংবাদ পাঠ করেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডা. বেলায়েত হোসেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সংবাদটি ইংরেজি করে পাঠ করেছিলেন। সে সময় উপস্থিত ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল্-হারুন, শাহ ই জাহান চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা, কর্মী। এই বক্তব্যগুলো ছিলো জ্বালাময়ী ভাষায়। বিশেষ করে বাংলা সংবাদ পাঠ করেছিলেন কোন স্ক্রিপ্ট ছাড়াই। এখানে বেতারের কোন ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি সত্য তবে দেশের বিপ্লবের এই সময়ে সংবাদটুকু ছিলো দেশবাসির নিকট কাম্য। মানুষ একটি নির্দেশনা পেয়েছিলেন। এটা কিন্তু কম সাহসের কথা নয়। এখানে আমরা ২৭ তারিখ বিকেলের তথ্যও পেয়েছি। মেজর জিয়াউর রহমান এর প্রথম স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাঁর দ্বিতীয় ভাষণ, তাঁর তৃতীয় ভাষণ সবগুলোই মানুষকে উজ্জীবিত করেছিলো। আবুল কাসেম সন্দ্বীপের বক্তব্য বা ভাষণ ছিলো চেতনামূলক, ডা. এম. এ মান্নানের আবেগ প্রবন জ্বালাময়ী ভাষণ ছিলো রক্ত গরম হওয়ার মতোই। মানুষ তখন জেনেছিলো বাঙালি সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, নেতারা পালিয়ে যায়নি, তারা লড়ছে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। একথাগুলো এতোদিন আমরা জেনেছি, শুনেছি কিন্তু পাইনি কোন প্রমাণ। এখন আর লিখে বা না লিখে প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করার সুযোগ নেই। যারা ইচ্ছা করে তথ্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন বা ঘটিয়েছেন অথবা কাউকে ছোট করার চেষ্টা করছেন তাদের সেই শ্রম পন্ডশ্রমে পরিণত হবে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নিয়ে যারা তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছেন বা ২৬ মার্চ প্রথম অধিবেশনে, ২৭ মার্চের প্রথম অধিবেশনকে তথ্যের মধ্যে আনেননি বা আনতে চাননি এখন তারা কি জবাব দেবেন? স্বাধীনতার ৫০ বছর মানে স্বাধীন বাংলা বেতারেরও কিন্তু ৫০ বছর। তাহলে সত্য প্রকাশে রাজনীতি কেন? ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর তো আমরা সবাই ছিলাম দলীয় রাজনীতির উর্ধে বরং ছিলাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রত্যক্ষ সৈনিক। তখনতো সত্য বলার সাহস ছিলো। তবে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনার প্রশ্নে এখন কেন বিভাজন?
সত্য হচ্ছে আমরা যারা লেখার মাধ্যমে বিভাজন করছি বা দলীয় চেতনায় ইতিহাস লিখার চেষ্টা করছি- এই মানসিকতার বিরুদ্ধে এই ক্যাসেটের মতো সত্য প্রকাশ পাবেই। আমাদের যন্ত্রণার কথা হচ্ছে কেন আমরা শুধু নিজের স্বার্থে, দলের স্বার্থে সত্য বলতে পারছিনা। কারো কারো মনের কথা হলো সবই আমি করেছি অন্যরা করেনি। আর কেউ কেউ পরিচয় দেওয়ার সময় বলেন আমিতো কমান্ডার ছিলাম। কেউ কেউ মনের যন্ত্রণা নিয়ে বলেন, সবাই যখন কমান্ডার বলেন তাহলে আমিতো সিপাহি মাত্র। প্রকৃত কমান্ডার যিনি তিনিতো নিজেকে কমান্ডার পরিচয় দেন না। মুক্তিযুদ্ধ এবং তৃণ মূলে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে চাইছি। মুক্তিযুদ্ধের চাইতে দলকে বড় করে দেখার চেষ্টা করছি।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রে রক্ষিত রয়েছে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা ২৭ মার্চের সকালের অধিবেশনের ক্যাসেটটি। এটি আবিষ্কার হওয়ারও একটি ইতিহাস রয়েছে। সময় পেলে অন্য সময় বলার চেষ্টা করবো।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।