: এক দফার প্রবক্তা এম.এ. আজিজ।
: ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হন। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত তাঁর রাজনীতির ধারাবাহিকতা ছিলো। রাজনীতির সূচনা থেকেই তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের সাথে। তৃণমূলে কাজ করেছিলেন আমৃত্যু। তাঁর রাজনীতি ছিলো চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী একজন ছিলেন সত্য কিন্তু চট্টগ্রামের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ১৯৬৬’তে বঙ্গবন্ধু যখন চট্টগ্রাম লালদীঘির মাঠে ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন সেদিন থেকেই তিনি গণতান্ত্রিক ধারাকে নিজের মধ্যে স্থাপন করে চিন্তা ও চেতনায় ছিলেন। পাকিস্তানী শাসন ও শোষণের বাইরে মুক্ত স্বদেশ ভূমি। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রলীগের একটি অংশ যখন স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের চিন্তা নিয়ে এগুচ্ছিলেন সে ধারার সাথে ছিলেন এম.এ. আজিজ। ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান যখন এই চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তখন তিনি চট্টগ্রামের আনন্দ বাজার গ্রামে এম.এ. আজিজ এর সাথে বৈঠক করেছিলেন। এই পরিকল্পনা এতোটাই গোপন ছিলো তখন নিজের আপন মানুষকেও বলার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। তারপরও এম.এ. আজিজ অতি গোপনে ৬ দফার ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে বাঙালিদের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন। ছাত্রলীগের জেলা শাখার কিছু সাহসী, মেধাবী ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের বীজ আস্তে আস্তে বপন করে সৃষ্টি করেছিলেন ‘মুক্তি বিপ্লবী’ গ্রুপ। এই গ্রুপের সদস্যরা ছাত্রলীগের সভায়, মিছিলে এমন সব স্লোগান তুলতেন যা ছিলো অতি মাত্রায় সাহসী। এদের অনেকে অতিবিপ্লবী বা পাতিবিপ্লবী বলে কটাক্ষ করতেন। এরা শতভাগ আশ্রয় পেতেন এম.এ. আজিজ-এর নিকট। বঙ্গবন্ধুর নৈতিক সমর্থন যখন পাওয়া গেলো তখন রাজনীতির মাঠে জয় বাংলা এসে গেছে। মুক্তি বিপ্লবী গ্রুপ তাদের সমর্থনের জায়গাটা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আঞ্চলিক শাখাগুলোতে ছড়িয়ে দিতে থাকে। তখন মূলত: তৃণমূলে ছাত্রলীগের অবস্থান বেড়ে যায়। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ৬ দফার প্রশ্নে আজিজ-জহুর যখন এক হলেন তখন আওয়ামী এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির নৈতিক প্রভাব বিস্তার লাভ করেছিলেন।
: ১৯৭০ এর নির্বাচনে এম.এ. আজিজ এর কৌশল।
: বঙ্গবন্ধু ছিলেন এম.এ. আজিজ এর বিশ্বাসের সাথে। এই নির্বাচন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর কয়েক দফা গোপন বৈঠক হয়েছিলো। তিনি বঙ্গবন্ধুর নিকট কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একটি প্রস্তাব ছিলো মুসলিম লীগ পরিবারগুলোকে নির্বাচনে হয় নিস্ক্রিয় রাখা অথবা নৌকার প্রতীক প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া অথবা দু’টোই। বঙ্গবন্ধুর সবুজ সংকেত পেয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিলো মুসলিম লীগ পরিবারের কিছু মানুষ ছিলেন যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেন, এম.এ. আজিজকে নেতা মানেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেন না। এদের দলের প্রার্থী করলে দল লাভবান হবে, যেমন
১. মুসলিম লীগ পরিবার থেকে যাদের আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়ে নমিনেশান দেওয়া হবে তারা শিক্ষিত ও সজ্জন।
২. তাঁদের সবার সামাজিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি রয়েছে, স্থানীয়ভাবে মানুষ তাদের মানে, সম্মান করেন।
৩. তাঁদের জন্য দলের অর্থ খরচ করতে হবে না, বরং তারা দলের অন্য প্রার্থীকে সহায়তা করতে পারবেন।
৪. তাঁদের পরিবার, আত্মীয় স্বজন এবং প্রজারা দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে মাঠে থাকবেন।
১৯৭১ এর নির্বাচনে এম.এ. আজিজ এর কৌশলে কাজ করেছিলো এবং তিনি এমন কিছু মানুষকে নির্বাচনে এম.এন.এ ও এম.পি.এ মনোনয়ন দিয়েছিলেন তাঁরা সবাই জিতেছেন। শুধু তাই নয় তাঁরা তাদের পক্ষে মুসলিম লীগের শক্তিকে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। যদিও কেউ কেউ এর বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন তারপরও তিনি ছিলেন সিদ্ধান্তে অটল এবং বঙ্গবন্ধুকে সে আসনগুলো উপহার দিতে পেরেছিলেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দেশের প্রথম ও প্রধান রাজনৈতিক দলের সম্মান ও মর্যাদা পেলেন ঠিকই কিন্তু তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনীতির দর্শনের বলে বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে দেবে না। এই ধারণা বলে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলেন, কথা বললেন, শপথ নিলেন দলের সাথে কেউ বেঈমানী করবেন না। তিনি চট্টগ্রাম এসেই বলতে শুরু করলেন পাকিস্তানীরা আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। তাই তিনি তার মুক্তি বিপ্লবীদের মাধ্যমে ও নিজে প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন, ৬ দফার পক্ষে বাঙালিরা ক্ষমতায় যেতে না পারলে আমরা চট্টগ্রাম থেকে ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবো এবং তিনি মিরশ্বরাই এর জনসভায় এই বক্তব্য তুলে ধরেন। ছাত্রলীগ জনতার কাতারে অবস্থান নিয়ে ঘোষণা করেছিলো, স্লোগান তুলেছিলো আর নয় ৬ দফা এবার চলবে ১ দফার সংগ্রাম। এর পরই তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেলে চলে যান। প্রবল আন্দোলনের মুখে তাঁকে পাকিস্তানী সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পেয়ে তিনি পুনরায় ৬ দফার সংগ্রাম নিয়েই তাঁর বক্তৃতা শুরু করতেন। আবার শেষ করতেন ১ দফার সংগ্রামের কথা বলে। আস্তে আস্তে ১ দফার কথা জনমনে বিস্তার শুরু হতে থাকে। ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগতো আর রাখঢাক করে রাজনীতি করেনি। তারাতো প্রকাশ্যে স্বাধীনতার কথা বলে স্লোগান তুলতেন। আওয়ামী লীগের বিশেষ একটি গ্রুপ ছিলেন যারা এম.এ. আজিজ এর সুরেই কথা বলতেন।
: ১১ জানুয়ারি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ।
: হঠাৎ করে তিনি স্ট্রোক করে মারা গেলেন। সমস্ত রাজনীতির স্রোত তখন এম.এ. আজিজ এর মৃতদেহকে ঘিরে। সবার কন্ঠে ছিলো ১ দফার প্রবক্তা, বঙ্গবন্ধুর দক্ষিণ হস্ত চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু এলেন তাঁর বাড়িতে। সাথে তাজউদ্দিন আহমদসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সকল স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা। চট্টগ্রাম সেদিন ছিলো শোকের নগরী, মানুষের নগরী। জানাজা হওয়ার কথা ছিলো লালদীঘি মাঠে কিন্তু মানুষের সমাগম বেশি ছিলো বলে স্থান বদল করে আনা হলো পলো গ্রাউন্ডে। সেখানেও মানুষের ঠাঁই হয়নি। মানুষ আর মানুষ। তারপর নিজ বাড়ি অর্থাৎ হালিশহর আনন্দ বাজার গ্রামের বিশাল ধানের জমিতে। কোথা থেকে এলেন এতো মানুষ। কয়েক বার জানাজার পর তাঁকে দাফন করা হয়েছে পিতা মহব্বত আলীর কবরের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন সেখানেও গিয়েছিলেন। দল ও মতের ঊর্ধ্বে ওঠে সকল দলের নেতারা বিলাপ করে কেঁদে ছিলেন। এই মানুষটি পুরো জীবন কাটিয়েছিলেন
১. মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে।
২. আওয়ামী লীগকে চট্টগ্রামের তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
৩. দেশকে ১ দফার মাধ্যমে স্বাধীন করার জন্য।
তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভবিষ্যৎবাণী সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তানীরা বাঙালিদের ক্ষমতা না দেওয়ার জন্য প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছিলো, বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করেছিলো, গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রের সম্ভার বাড়িয়েছিলো এবং আলোচনার মাঝপথে ভূট্টো ও ইয়াহিয়া বাঙালি নির্ধনের নির্দেশ ‘আপারেশন সার্চলাইট’ এর নির্দেশ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। আর বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা করে বাস্তবায়ন করলেন এম.এ. আজিজ এর ১ দফার মূলসৃষ্টি স্বাধীন বাংলাদেশের। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টার স্থানটিতো তাঁকে দেওয়া যেতে পারে। সেই যে নিউক্লিয়াস দেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলো তা সফল হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা এবং এম.এ. আজিজ এর মতো দর্শনিক নেতা ছিলেন বলেই। যদিও তিনি দেখে যেতে পারেননি তাঁর কাংখিত ১ দফার বাংলাদেশকে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।