: করোনাকালীন শিক্ষা ভাবনা, রাজখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল এবং একজন গিয়াস উদ্দিন এর কথা।
: সরকার দীর্ঘদিন থেকেই ভাবছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরে শিক্ষার্থীদের স্কুলেই খাওয়াবে। কেমন করে খাওয়াবে বা কেমন করে রান্না হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ভাবছে। এই ভাবনা থেকেই কর্মকর্তারা এই বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশ সফরের কথা পরিকল্পনায় আনেন। বাজেট নির্ধারিত হয় ৫ কোটি টাকা। এই তথ্য প্রকাশের পর বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ আসে ‘খিচুড়ি প্রকল্পের বিদেশ সফরের খরচ হবে ৫ কোটি টাকা’। বিদেশ সফরে গিয়ে তারা কি শিখবেন, কি দেখবেন বা কেমন করে খিচুড়ি রান্না হয় বা কেমন করে খাওয়ানো হয় এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে জানাইতো মুখ্য। তখন একজন এ জে এম গিয়াস উদ্দিন কৌতুক করে জানালেন, এই প্রশিক্ষণ বা জ্ঞান অর্জন বা খিচুড়ি রান্নার জন্য বিদেশে গিয়ে ৫ কোটি টাকা খরচ করার প্রয়োজন কি? অনুগ্রহ করে তাদের বলুন, আমার পরিচালনাধীন রাজখালী সরকারি প্রাইমারি স্কুলে আসতে, তাহলে তারা প্রতিদিনের মিড ডে মিলের পুরো তথ্য জেনে যাবেন এবং কতো টাকা খরচ হয় তাও জানবেন। ৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে না (যদিও এই খরচ বাতিল হয়েছে)।
: বলছি সে স্কুলে মিড ডে মিলের আরো তথ্য।
: স্কুলটির বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১’শ জনের বেশি। সপ্তাহে ৬ দিন স্কুল খোলা থাকে। ২০১৫ থেকেই এই স্কুলের প্রতিজন ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক কর্মচারিরা দুপুরে স্কুলে খাওয়া দাওয়া করেন। উদ্যোগ নিয়েছিলেন এলাকার শিক্ষানুরাগী এ জে এম গিয়াস উদ্দিন এবং তার ক’জন বন্ধু। কেন তারা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় যে, তিনি স্কুল কমিটির সভাপতি হওয়ার পর শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় করে জানতে পারেন যে,
১. ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিত স্কুলে আসে না।
২. স্কুলে আসলেও টিফিন ছুটির পর বেশির ভাগই স্কুলে আর ফিরে আসেনা।
না আসার প্রধান কারণ ছিলো দারিদ্র্যতা। পুরো এলাকাটা মানুষের কর্মের সংস্থান হচ্ছে লবণের মাঠ। এখানে তারা কাজ করে। ফলে অর্থের সংকট তাদের খুব বেশি। অভিভাবকরা মনে করতেন স্কুলে যাওয়ার চাইতে লবণ মাঠে কাজ করলে কিছু টাকা আসবে। এজন্য যারা স্কুলে আসেনা তারা চলে যায় লবণ মাঠে শ্রমিকের কাজ করতে। আবার যারা সকালে এসে দুপুরে চয়ে যায় তারা একবেলা মাঠে কাজ করে। সামান্য অর্থ পায়। দুপুরের খাওয়া চলে। তখন তিনি বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন জনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার শুরু করলেন। প্রচারের পাশাপাশি তারা চিন্তা করলেন শিশুগুলোকে স্কুলে আসার জন্য উৎসাহী করা যায় কি ভাবে? এই চিন্তার বাস্তবায়নে কাজ শুরু করলেন। কাজটা কি?
১. প্রতিদিন দুপুরে স্কুলে রান্নার ব্যবস্থা করলেন।
২. দুপুরে স্কুলে প্রতিজন শিক্ষার্থীকে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
৩. মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারিরাও একই খাওয়া খাচ্ছেন।
৪. কমিটির সদস্যরাও মাঝে মাঝে স্কুলে বসে একই খাওয়া খান।
এলাকার মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার জন্ম নেয়। প্রতিদিন বাবুর্চি সকালে রান্না শুরু করেন। এখানে প্রতিজন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য আলাদা প্লেট, গ্লাস রয়েছে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় থাকছে। এরপর দেখা গেলো এলাকায় নতুন ঝড়। সরকার গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা করে দেয়। প্রথম দিকে বাবা-মা’রা এই টাকা দিয়ে পান, সিগারেট এবং দোকানে বসে খেয়ে নষ্ট করে ফেলতেন। শিক্ষার্থীর কোন উপকারে আসতোনা। স্কুলে দুপুরের খাবার দেওয়ার পর কিছু কিছু অভিভাবক ভাবলেন আমরাও কমিটির সদস্যদের সাথে অংশীদার হবো। তারা কমিটির মতে ঐ ১০০ টাকা দিয়ে বললেন, আমাদের ক্ষুদ্র অংশগ্রহণ। তারপর প্রতিজন অভিভাবক অংশীদার হলেন। এই খরচের উৎস কোথায়?
১. শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা সরকারি অর্থের ১০০ টাকা।
২. এলাকার মানুষের অর্থ সাহায্য।
৩. কমিটির মানুষদের উদার সহযোগিতা।
: তাদের খাবার ম্যানু কি?
: খিচুড়ি রান্না হয় বেশির ভাগ সময়। এইজন্য পুষ্টিবিদের সহায়তা নিয়ে থাকেন। এটা যে মিড ডে মিল তাতো নয়, বরং এই খাদ্যে থাকে একজন শিশুর জন্য সমস্ত পুষ্টিগুণ। খাদ্য মৌসুম অনুযায়ী রান্না করা হয়। যেমন-
১. শীতের সময় শীতের সবজির মিশ্রণ।
২. ডিম বা মাঝে মাঝে মাংস।
৩. মৌসুমী ফলও তাদের মাঝে মধ্যে দেওয়া হয়।
আগে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে চাইতো না, এখন তারা কখন স্কুলে আসবে সেজন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। স্কুলে আসা শুধু দুপুরের খাওয়ার জন্য তাতো নয়, বরং স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক শিক্ষিকারা এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন যাতে করে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসে আনন্দের সাথে শিখতে ও পড়তে পারে। এর নেপথ্যের কারণ কি?
১. শিক্ষার্থীরাই স্বেচ্ছাসেবক, তারাই তাদের কাজ শেষ করে আনন্দের সাথে।
২. স্কুল বসার আগেও পরে খেলাধুলা করতে পারে।
৩. শিক্ষক-শিক্ষিকারা দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের পেছনে বাড়তি সময় ব্যয় করে তাদের তৈরি করেন।
৪. শিক্ষার্থীরা প্রচুর আদর পান এবং তাদের মাঝে জন্ম নেয় নেতৃত্বের গুণ।
পূর্বে যেসব শিক্ষার্থী স্কুলে ঝিমিয়ে থাকতো বা শ্রেণিকক্ষে ঘুমিয়ে পড়তো বা দুর্বল অবস্থানে ছিলো তারা অল্প ক’দিনেই ঝরঝরা হয়ে যায়। কারণ নিয়মিত পরিচর্যা, স্বাস্থ্য জ্ঞান ও দুপুরের খাবার। বিগত ৫ বছর থেকে এই স্কুলে মিড ডে মিল চালু করার পর স্কুলের মৌলিক চেহারা, ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ জে এম গিয়াস উদ্দিন তার সতীর্থদের নিয়ে একাজটি চালু করে চিন্তা করেছেন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ফলে হয়েছেটা কি?
১. এই প্রকল্পটি টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন নতুন চিন্তায় এগিয়েছেন।
২. এলাকার মানুষের পরামর্শ ও সাহায্য নিয়েছেন।
৩. নিজ পরিবারের সদস্যদের এই দান প্রকল্পের সতীর্থ করেছেন।
৪. পুষ্টিবিদের সাহায্য ও পরামর্শ নিয়েছেন।
৫. শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের এই কাজে সম্পৃক্ত করেছেন।
প্রচুর শ্রম, প্রাথমিক সমালোচনার পথকে সুকৌশলে পরিহার করে বিগত ৫ বছর রাজাখালী সরকারি প্রাইমারি স্কুল মিড ডে মিল বা দুপুরের খাবার প্রকল্প চালু রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই প্রকল্পটি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার। নিজ এলাকার মানুষের প্রতি ভালোবাসার আকর্ষণই হচ্ছে জয়ের মূল উৎস। আমরা ক’জন বন্ধু ডা. কাজী আইনুল হক, কবি মোর্শেদ জাফর, সেবক পুরুষ আলহাজ্ব লিয়াকত আলী এই প্রকল্প দেখার জন্য পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে বিস্ময়কর প্রকল্প দেখে এসেছিলাম। এই মিড ডে মিল প্রকল্পটি দেখে আসার জন্য যারা খিচুড়ি প্রকল্পের জন্য জ্ঞান অর্জন করতে বিদেশে যে ৫ কোটি টাকা খরচের চিন্তা করেছিলেন তাদের বলবো এই স্কুলে গিয়ে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করুন অথবা ০১৭২০২৫০৯৬০ নম্বরে ফোন করে তথ্য নিন। বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। এই স্কুলটির প্রতি বছরই পাশের হার ১০০%।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।