ডাঃ সামিনা আক্তার। বয়স ৪৫। উদীয়মান এক তরুণী চিকিৎসক। স্বপ্ন ছিল অনেক বড় আবেদনবিদ হবেন। গরীব ও দুঃস্থ মানুষের সাহায্যার্থে ছুটে যাবেন রাত-বিরাতে। কিন্তু সেই স্বপ্নের আকাশে যেন অমানিশার কালো ছায়া এসে বাসা বেঁধেছে। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হল না। চলে গেলেন মহাশক্তিমান আল্লাহর দরবারে। সামিনা আর কোনদিন ফিরবেন না এই অঞ্চলে। এতিম হয়ে গেল তার দু’টি সন্তান। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাত ১০ টার দিকে কাজির দেউরি রেডিসন ব্লু হোটেলের সামনে ডাঃ সামিনার বহনকারী রিকশাকে একটি অটো রিকশা সজোরে ধাক্কা দেয়, এতে তিনি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে যান এবং রোড সাইডে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাতপ্রাপ্ত হন। এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান রাস্তায়। পথচারীরা দ্রুত তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান। তার ভ্যানিটি ব্যাগ তল্লাশি করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। এনেস্থেসিয়া বিভাগের চিকিৎসকরা তাঁকে ওটিতে নিয়ে যান এবং নিউরোসার্জারী বিভাগের চিকিৎসকগণ তাঁকে দ্রুত অস্ত্রোপচার করেন। অস্ত্রোপচার শেষে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয় কিন্তু তাঁর আর জ্ঞান ফেরেনি। নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর নোমান খালেদ চৌধুরী, ডাঃ সানাউল্লাহ শামীম, ডাঃ মাজেদ সুলতান, ডাঃ কামাল হোসেনসহ একদল চিকিৎসক ডাঃ সামিনার মাথায় অস্ত্রোপচার করেন। তাঁর মাথার temporal lobe, parietal lobe এবং frontal lobe- এই তিনটি ষড়নব ক্ষতিগ্রস্ত হয়-যাকে মেডিকেল পরিভাষায় বলা হয় massive haemorrhage। তাঁর GCS (glassgo coma scale) ছিল ৩। ঘটনার দিন রাত ১ টায় তাঁর অস্ত্রোপচার শুরু হয় এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৪টায় শেষ হয়। ডাঃ সামিনা acute sub-dural haematoma with acute sub-arachnoid haemorrhage with intracerebral haemorrhage রোগে ভুগছিলেন। ঘটনার মাত্র দু্থদিন পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রোজ বৃৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটায় চট্টগ্রামের সমস্ত চিকিৎসক সমাজ, তাঁর ঘনিষ্ঠজন ও অনেক সহকর্মীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। ডাঃ সামিনা ইউএসটিসি’র ৫ম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। ইউএসটিসি আইসিইউ বিভাগে প্রায় ০৪ বছরের অধিককাল মেডিকেল অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। করোনা মহামারির সময় তিনি ইউএসটিসিতে আর যাননি। পরে সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনেস্থেসিয়া বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসাবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি এমডি কোর্সে ভর্তি হন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ফেনী হলেও চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদীবাগে পরিবার নিয়ে থাকতেন। সামিনার মেয়ে রাফা ওয়ালিয়াহ নবম শ্রেণীতে ও ছেলে মীর ওয়ালিফ সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। একজন সামিনা আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- এ দেশের সড়কে হাজারো মৃত্যুর মিছিলের দৃশ্য- প্রতিদিন ঝরছে অনেকগুলো প্রাণ- সর্বস্বান্ত হচ্ছে হাজারো পরিবার। সড়কগুলো হয়েছে যেন মৃত্যুফাঁদ। সড়কের প্রতিটি ইট-সুড়কিতে রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা আর গাফেলতির ভয়াল চিহ্ন। অদক্ষ গাড়িচালক ও গাফেলতি সড়কে এতগুলো মৃত্যুর মূল কারণ। এভাবে আর কত ঝরবে মানুষের প্রাণ সড়কে সড়কে? ডাঃ সামিনার পরপরই নোয়াপাড়া পথেরহাটে পিএইচপি গ্রুপের এক তরুণ প্রকৌশলী প্রাণ হারান সড়কেই। এর আগেও কক্সবাজারের ডুলাহাজারা এলাকায় একসাথে ৫ ভাইয়ের করুণ মৃত্যু কারো অজানা নয়। একসাথে এত ভাইয়ের মৃৃত্যু দেশবাসী হয়তো কখনো দেখেনি। এভাবেই চলছে মৃত্যুর ভয়ার্ত অভিমান। এভাবেই চলে যেতে হবে সব আদম সন্তানকেই,-‘(কিন্তু) কারো (নির্ধারিত) ‘সময়’ যখন এসে যাবে, তখন আল্লাহ তায়ালা কখনোই তাকে (এক মুহুর্ত) অবকাশ দেবেন না; তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) যা কিছু করছো, আল্লাহ তায়ালা সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত রয়েছেন’- সূরা আল মোনাফেকুন-১০। কিন্তু ডাঃ সামিনার মতন মৃত্যু কারো কাম্য নয়। এভাবে সড়কে মৃত্যু যেন অপ্রত্যাশিত এক দুঃসহ বেদনার ক্ষত বয়ে বেড়ায় সারা জিন্দেগীভর সেই পরিবারে। পারিবারিক কারণে হয়তো ডাঃ সামিনার মানসিক অবস্থা সংযত ছিল না। কিন্তু মহিমান্বিত আল্লাহ তায়ালা যার মৃত্যু যে অবস্থায়, যেখানে রেখে দিয়েছেন তার কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। আমরা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি- যেন আমাদের মৃত্যু হয় জুমাবারে এবং নামাজের সময় আর এই মৃত্যু যেন হয় অযু অবস্থায়। ডাঃ সামিনার মৃত্যু হয়েছিল বৃহস্পতিবারে- যেদিন বান্দার দ্বিতীয় আমলনামা জমা হয় আল্লাহর আরশে। আর এই দিনটি অত্যন্ত মর্যাদাবান। বিশ্বনবী, আমাদের প্রিয় রাসূল (সাঃ) এই দিনটিতে রোজা রাখতেন। সেই দিকটা দিয়ে ডাঃ সামিনা অত্যন্ত ভাগ্যবতী। হয়তো ডাঃ সামিনার জন্য আমার রাব্বুল আলামিন ঐ দিন সাড়ে আটটা পর্যন্ত হায়াত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তার এক মুহুর্ত এদিক-সেদিক হবে না। তেমনিভাবে প্রত্যেকটা আদম সন্তানের মৃত্যুর সময় নির্ধারিত আছে আমার আল্লাহতায়ালার কাছে, ‘কোন প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরবে না, (আল্লাহতায়ালার কাছে সবার) দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট’-সূরা আল-ইমরান-১৪৫। জানিনা আর কত সামিনা এভাবেই চলে যাবে সড়কে- অসম্ভব অব্যবস্থাপনা দেশময় সড়কসমূহে- মনে হয় না এদেশে আছে কোন আইনের শাসন, আছে রাষ্ট্রের কোন নির্দেশনা। অভিযুক্তরা নিমিষেই পার পেয়ে যায় আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে। কি দুর্বল এই আইনের শাসন-ভাবতেই যেন অবাক লাগে। এভাবেই বলি হতে হয় ডাঃ সামিনাদের। এর পরে কার ভাগ্যে জুটবে সামিনার মতন অভাগা মৃত্যু? আমরা অন্তরের গভীরতা থেকে ডাঃ সামিনার জন্য দোয়া করছি হৃদয়সমূহ উজাড় করে। মহান আল্লাহ যেন ডাঃ সামিনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সুউচ্চ মাকাম দান করেন। মা হারানো দুটি সন্তান যেন মায়ের আদর্শে নিজের জীবনটাকে গড়ে তোলে। নেক সন্তান হিসাবে যেন ডাঃ সামিনার কাছে সাদকায়ে জারিয়াটুকু পৌঁছে যায় কবরের মাটির গভীরে। আর ডাঃ সামিনার কেয়ামতের প্রথম ধাপ শুরু হয়ে গেছে ১৭ ফেব্রুয়ারি বিকালে গ্রামের বাড়িতে দাফনের পরপরই- কবরের ফেরেশতা মুনকার-নাকীরের হিসাব-নিকেশ শুরু হয়ে গেছে তখনই- তিনটি প্রশ্নের উত্তর যেন ডাঃ সামিনা অনবদ্যভাবে দিতে পারেন এবং তাঁর কবরের সাথে যেন জান্নাতের মিলন ঘটে-সেই অভাবনীয় দোয়াটি আজ এই মূহুর্তে উৎসর্গ করে দিলাম। অবিরাম ভাল থেকো ডাঃ সামিনা। আমিন।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি