১৯৫৮ সালের ডিসেম্বর মাস। আমি তখন পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। সপ্তাহখানেক আগেই বার্ষিক পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে আমি অষ্টম শ্রেণি থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে নবম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছি। মনটা তেমন ভালো যাচ্ছিলনা। বছর খানেক পূর্বে আমাদের কোকদন্ডী গ্রামের বণিক পাড়ার মেধাবী, সজ্জন ব্যক্তিত্ব পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু হরিবিলাস ধর (বি.কম) এবং বাঁশখালী তথা চট্টগ্রামের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসবিদ, আমাদের পরিবারের একান্ত সুহৃদ ও পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা চাপাছড়ি গ্রামের ড. আবদুল করিমের বিশেষ অনুরোধ রক্ষার্থে আমার ডাঃ কাকু আমাকে কালীপুর এজহারুল হক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ট্রান্সফার নিয়ে পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছিলেন। কালীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু সূর্য কুমার দাশ আমাকে পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কেননা আমি ঐ বিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় থেকে ফুল–ফ্রি নিয়ে পড়ছিলাম। আমাদের বাড়ির পশ্চিমে পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা ঘাটও তখন চলাচলের উপযোগী ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের গ্রামের আরও দুজন শিক্ষক বাবু কালিপদ দে (এম. কম) ও সুধীর বিমল দাশ (বি.এ) পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। তখন অবশ্য মনে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল।
বিদ্যালয়ের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সপ্তাহ খানেক পূর্ব থেকেই ছাত্র–ছাত্রীদের বিভিন্ন ইভেন্টে ভাল পারফর্ম করার নিমিত্ত রিহার্সেলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তদুপরি সেবারের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসছিলেন বাঁশখালীর অহংকার, গণমানুষের পরম ভরসাস্থল, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ ও সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন কিংবদন্তি ইতিহাসবিদ, বাঁশখালীর অনন্য ব্যক্তিত্ব ড. আবদুল করিম। প্রায় সহস্রাধিক লোকের উপস্থিতিতে পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের প্রবেশ পথে সুরম্য গেইট তৈরি করে পশ্চিম পাশে পূর্বমুখী সুসজ্জিত স্টেজটি বেশ চোখ ধাঁধানোই লাগছিল! আমরা বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে তুমুল করতালি পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম! আমি একাই তিনটি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলাম, ক্লাসে প্রথম হয়ে একটি, ক্লাসে শতভাগ উপস্থিতির জন্য একটি ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ আবৃত্তি করে আবৃত্তি ইভেন্টে প্রথম হয়ে একটি।
পুরস্কার বিতরণের পর প্রধান শিক্ষকের নাতিদীর্ঘ ভাষণের পর মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয় আমার ইভেন্ট ‘দুই বিঘা জমি’ নিয়ে উপস্থিত জনতার সামনে সমাজে শোষকেরা কিভাবে গরীব, দুস্থ, অসহায় কৃষক সম্প্রদায়কে শোষণ করছে তার ওপর ঘন্টাধিক সময় পিনপতন নিস্তব্ধতায় নিরবচ্ছিন্ন ভাষণ প্রদান করে শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রেখেছিলেন! আমি ইতোপূর্বে বাঁশখালীর অসহায় কৃষককুল ও দুস্থ গণমানুষের মুক্তির কাণ্ডারী হিসেবে অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ সাহেবের নাম শুনেছিলাম। কিন্তু কখনো চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। সেদিনই প্রথমএই মনীষীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। যতই তাঁর ভাষণ শুনছিলাম ততই এক অপার্থিব অনুভূতি ও মুগ্ধতায় ডুবে গিয়েছিলাম!
সময় কারও জন্য অপেক্ষায় থাকে না। মাস, বছর পেরিয়ে কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত সেই অবিসংবাদিত, কীর্তিমান, বিপ্লবী চেতনায় বিশ্বাসী, স্বাপ্নিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ সাহেবকে ১৯৭৫ সালে প্রথম আমার চাম্বলের চেম্বারে দেখে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! আমি এই নন্দিত ব্যক্তির পায়ে ধরে সালাম করলে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে আমাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন কালীপুরের সমাজসেবক প্রিন্সিপাল জহির উদ্দীন আহমদ সাহেব ও আমাদের অগ্রজ সমাজ চিন্তক জনাব বখতিয়ার নূর সিদ্দিকী।
অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ সবাইকে একসাথে সমাজের দুর্নীতি দূরীকরণার্থে সোচ্চার হওয়ার ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাতেন। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাতেন গরীব, দুস্থ, অসহায় রোগীদের সেবায় মনোনিবেশ করে বিনা পারিশ্রমিকে তাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য। মাঝে মাঝেই তিনি তাঁর সাথীদের নিয়ে বাঁশখালীর প্রত্যন্ত এলাকায় গ্রুপ মিটিং করে ফেরার পথে আমার চেম্বারে আসতেন। কোনদিন চানাস্তা খাওয়ার পর অন্য কোথাও মিটিং থাকলে ভাত না খেয়েই চলে যেতেন। তবে বিদায় নেওয়ার সময় আমাকে আদেশের সুরে বলতেন, ‘মিলন, তুমি আমাকে একশত টাকা দাও। আমার লেখা বই ছাপাতে দরকার হবে’। আমি দু‘ শত টাকা দিলে তিনি একশত টাকা ফেরত দিতেন। আমি অপলক নেত্রে এই মহান ব্যক্তির শুভ্র, সৌম্য অবয়বের দিকে তাকিয়ে নিজকে পরম ভাগ্যবান মনে করতাম। তাঁর সারাটি জীবন ছিল ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত।
তিনি ভোগের জন্য এ পৃথিবীতে আসেননি। তিনি এসেছিলেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তৃপ্তি পেতে। অন্ধকার সমাজকে শিক্ষা– দীক্ষায় আলোকিত করে আনন্দ পেতে। মহান স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতাম, তাঁর সৃজনশীলতায় ও ঔজ্জ্বল্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আলোকিত হয়ে সেই আলো দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ুক। আমাদের প্রিয় জনপদ বাঁশখালী উপজেলার সোনার সন্তানেরা তাঁর দেয়া মশালটি আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে বাঁশখালী পেরিয়ে আরও বিস্তৃত জনপদে ছড়িয়ে যাক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকটি মানুষের ভিতর একজন চমৎকার মানুষ লুকিয়ে আছেন। নীরবে নিভৃতে একা হয়ে প্রতিদিন এই চমৎকার মানুষটির সাথে একটু কথা বলুন। দেখবেনএর মতো চমৎকার মানুষ দ্বিতীয় আর কেহই নেই’।
সামাজিক বিপ্লবের ধারক, শোষণের বিরুদ্ধে অদম্য প্রতিবাদী, আপাদমস্তক নীতিবান ও কীর্তিমান প্রবাদ পুরুষ, অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ (জন্ম –১৯১৪, মৃত্যু– ২৮ মে ১৯৯৪) আমাদের প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, বিরল প্রতিভার অধিকারী, এক অনন্য সমুজ্জ্বল নক্ষত্র, নির্লোভ, নির্মোহ, কৃষক –শ্রমিক– পশ্চাৎপদ গণমানুষের পরম ভরসাস্থল,অপূর্ব, অশ্রুত কথামালায় সমৃদ্ধ রম্যলেখক।
শৈশব, কৈশোর থেকেই তিনি তাঁর কোমল হৃদয়ের মনিকোঠায় একজন সৎ, যোগ্য, প্রতিভাধর শিক্ষক হওয়ার বাসনা পুষে রেখে ছিলেন ও সাথে সমাজের পিছিয়ে পড়া দুস্থ,নিঃস্ব, অসহায় কৃষক জনগোষ্ঠীর জীবন মানের সার্বিক কল্যাণ কামনায় ছিলেন বিভোর! বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ভবিষ্যতে তাঁর শিক্ষক হওয়ার সংকল্পকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি
কারণ তাঁরা শিক্ষককূলের হতদরিদ্র জীবন থেকে বের হয়ে তাঁদের নিজ নিজ সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখার আশা পোষণ করতেন!
বৃত্তি প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে ১৯৩২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৩৪ সালে আই,এ ও ১৯৩৬ সালে একই কলেজ থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি,এ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে ১৯৩৯ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। যদ্দুর জানা যায়, তিনি বাঁশখালী উপজেলার পঞ্চম এম, এ ডিগ্রি ধারী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বিতীয় এম,এ ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব।
তিনি চট্টগ্রাম কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ রায়বাহাদুর পদ্মিনীভূষণের কাছ থেকে একটি প্রশংসাপত্র যোগাড় করার অভিপ্রায়ে গেলে তখন কলেজের একজন ইংরেজির শিক্ষকের ছুটিজনিত কারণে তাঁকে প্রভাষক পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। এ কিংবদন্তি শিক্ষক পরবর্তীতে ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (বর্তমানে চট্টগ্রাম সরকারি মহসিন কলেজ), ফেনী কলেজ, লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। সে সময় ছাত্রছাত্রীরা পাঠ্য বইয়ের বাইরে ‘মেইড ইজি‘র প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করে ‘মেইড ভেরি ইজি‘ নামক এক রম্য পুস্তিকা লিখে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবুল খায়েরের মাধ্যমে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। সে সময় তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথেও সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। তাঁর বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনে তিনি ইস্ট বেঙ্গল টিচার্স এসোসিয়েশনের মুখপাত্র ‘দি টিচার’ সম্পাদনার গুরুদায়িত্বও পালন করেছিলেন। কুমিল্লায় গড়ে তোলেন প্রগতি মজলিশ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধাএই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এক সময় শিক্ষকতা জীবনের ইতি টেনে পূর্ণকালীন রাজনীতিবিদ হয়ে পড়েন।
১৯৫৪ খ্রি. যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বাঁশখালী আসন থেকে এম.পি.এ. (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) নির্বাচিত হয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম ও বাঁশখালীতে শিক্ষার প্রসার ও বাঁশখালীর তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামের উন্নত যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান সর্বজনবিদিত। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, বাঁশখালী কলেজ, সাধনপুর পল্লীউন্নয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও একজন সফল রূপকার। এছাড়াও সাতকানিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, পশ্চিম বাঁশখালী হাই স্কুল, চাম্বল হাই স্কুল, সরল আমিরিয়া হাই স্কুল ও বাহারচরা রত্নপুর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
রাজনৈতিক জীবনে (১৯৫৫) তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। একসময় তিনি দুস্থ, কৃষক সম্প্রদায়ের কথা চিন্তা করে তাঁদের দুঃখের সাথী হয়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে মৌলানা ভাসানীর ন্যাপে যোগদান করেন। মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক সম্প্রদায়ের কষ্ট দূরীভূত করার মানসে সারাটি জীবন তিনি নিরলস কাজ করে তাঁদেরকে সুসংগঠিত করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি বাঁশখালীর একজন অন্যতম সক্রিয় সংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলেন।
১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাপের কেন্দ্রীয় সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্টের এমপি থাকাকালে ৯২-(ক) ধারা জারি হলে তিনি গ্রেফতার হন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে তিনি হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। তখন তিনি বাঁশখালীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব কৃষকদের জীর্ণ কুঠিরে অত্যন্ত সাধারণ বেশভূষায় নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন!
১৯৬৬ সালে বাঁশখালীতে এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের জনসভায় অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসর বাঁশখালীতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে সবার সাহায্য ও সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। এখানে প্রসংগত উল্লেখ্য যে তিনি বেশ কয়েক বছর আত্মগোপনে থেকে ঐ দিনই সম্বর্ধনা সভায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। বাঁশখালীর আরও একজন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মরহুম এমতাজুল হক সাহেবও বাঁশখালীর শিক্ষা প্রসারের জন্য আজীবন সক্রিয় ছিলেন। বাঁশখালীর সার্বিক উন্নয়নে জনগণ তাঁকেও রাজনীতিতে যোগদান করার অনুরোধ জানালে তিনি বাঁশখালীতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থেকেই দেশমাতৃকার সেবা করার অঙ্গীকার করেছিলেন।
যে রাজনীতির জন্য আসহাব উদ্দীন আহমদ শিক্ষার জগত থেকে বের হয়ে এসেছিলেন সেখানে তাঁর মনোবাসনা পূরণ হয়নি। আশির দশকে এক অব্যক্ত মর্মবেদনা নিয়ে তিনি রাজনীতি ছেড়েছিলেন। অবশ্য এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘বোকার ফসল পোকায় খায়। এটা সর্বজনস্বীকৃত একটা প্রবচন। দলের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা পোকারা বোকাদের উৎপাদিত ফসল খেয়ে তরতাজা হয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে মসনদে বসে ত্যাগী কর্মীদের মই হিসেবে ব্যবহার করে মন্ত্রীত্বের গদিতে বসে মইটি পায়ে ঠেলে নীচে ফেলে দেয়’! আসহাব উদ্দীন আহমদ সাহেবেরএই সরল স্বীকারোক্তিতে সহজেই অনুমান করা যায় তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে আমাদের পচনশীল ঘুনে ধরা রাজনীতির কোনই সামঞ্জস্য ছিল না! তাই তিনি নিজেকে আত্মস্বীকৃত ‘বোকা মিয়া‘ ভাবতেন!
‘বোকা মিয়ার ইতিকথা’ নামে তাঁর বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমার মতো সহজ সরল মানুষের জন্য রাজনীতি বেমানান! আমি যেন এক পথভোলা রাজনীতিক। দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক জীবনকে তাঁর দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। তাঁর এই মোহভঙ্গের কারণে মনের গভীরে হতাশা নেমে আসলেও তিনি দুঃখী কৃষক ও দুস্থ মানুষের সেবা থেকে অব্যাহতির পথ বেছে নেননি। প্রগতিশীল লেখকদের সংগঠন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাথে যুক্ত হয়ে অন্তরের ফল্গুধারা মিশিয়ে রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এই মহিমান্বিত লেখকের রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ‘ছাব্বিশটি‘।
অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ শিক্ষকতা ও সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের ইতি টেনে নিজের সমস্ত সত্তাকে বিলিয়ে দিয়ে অনগ্রসর বাঁশখালী জনপদকে ও অসহায়, দুস্থ, কৃষক সম্প্রদায়ের মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন কর্ম আর পরবর্তীতে সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে নূতন প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করে গিয়েছিলেন। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য বাঁশখালীর আগামী প্রজন্ম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরে সামনে এগিয়ে যাবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। বিনিময় বলে একটা কথা আছে। যে মহানুভব ব্যক্তিটি, আমাদের জনপদকে শিক্ষার আলোয় গৌরবোজ্জ্বল করে তুলতে ও গরীব কৃষককূলের আর্থিক, সামাজিক ও রুগ্ণ, ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় পুরো জীবনটাই বিলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন তার বিনিময়ে আমরা এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি কতটুকু সম্মান প্রদর্শন করছি!
প্রথিতযশা এই বরেণ্য ব্যক্তিকে বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে ‘একুশে পদক’ প্রদান করে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন। তাঁর শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন মসজিদের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আমাদের আকুল প্রার্থনা, গণমানুষের এই অনন্য ব্যক্তির জীবনের উত্তম কাজগুলো কবুল করুন। আমিন।
লেখক : প্রাক্তন চীফ মেডিকেল অফিসার, বি.এস. এফ. আই.সি। চেম্বার : পপুলার, শান্তিনগর, ঢাকা।