মাতৃগর্ভে প্রাণ সৃষ্টির পর থেকেই একজন মানুষের জীবনের সূচনা ঘটে। জীবনের অর্থ খোঁজা তখনও শুরু হয় না। পরিবারের মাঝে শিশু হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে একজন মানবের।আর সেই থেকে বাবা– মায়ের নতুন করে জীবন যুদ্ধেরও সূচনা হয়। স্বপ্ন দেখা আরম্ভ হয় শিশুকে ঘিরে। শিশুকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারটার তাগিদ অনুভব করেন। অনেক ক্ষেত্রে শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার আগে থেকেই ভাবনার জাগরণ ঘটে। লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার ভাবনায় যুক্ত হয় আর্থিক চাপ।সে সাথে আপনি আপনি ভর করে মানসিক চাপও। এই আর্থিক এবং মানসিক চাপ মূলত সামাজিক চাপের কারণেই সৃষ্ট।
বাবা– মা তার সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন তাহলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। যার কারণে বাবা– মা তাদের নিজের জীবনের সমস্ত সাধ– আহ্লাদ, প্রয়োজন বিসর্জন দিতে শুরু করেন। একদিকে অর্থ সঞ্চয়ের চিন্তার নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে শরীরের ঘাম ঝরান আর অন্যদিকে দৌড়ঝাঁপে বলীয়ান হয়ে ছুটেন সন্তানকে নিয়ে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার এবং টিউটরদের কাছে। নেমে পড়েন আঁটঘাট বেঁধে প্রতিযোগিতায়।
প্রতিবেশি, বন্ধু – বান্ধব, আত্মীয়–স্বজনদের সন্তানেরা বড় বড় পদে প্রতিষ্ঠা লাভ করে সমাজে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। নিজেদের সন্তানকেও সেই পর্যায়ে যেভাবেই হোক পৌঁছুতে হবে। তা না হলে মান–সম্মান জলে – ধুলায় মিশে গিয়ে একাকার হয়ে যাবে। আর এই চাপ গিয়ে পড়ে সন্তানের ওপর।
শিশু তার মা– বাবার এরূপ কথা শুনে শুনে নিজেকেও সেই ছাঁচে অভ্যস্থ করার যুদ্ধে নেমে পড়ে। সমাজে মা– বাবার, পরিবারের সম্মান বলে কথা। শিশু তার সমস্ত ইচ্ছা, আগ্রহকে একপাশে রেখে লেগে পড়ে প্রতিযোগিতায়। মা – বাবা বা পরিবারের সদস্যরা যতটা না দুঃখ হতাশায় ভোগেন তার চেয়ে প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠে সমাজে সন্তানের ব্যর্থতার জন্য মুখ দেখানো যাবে না সেই চাপে। তাই আমাদের সমাজে অহরহ ঘটতে দেখা যায় শিশু– কিশোরদের আত্মহননের ঘটনা, যার পেছনে দায়ী সামাজিক চাপ। অথচ, একটু চিন্তা করলেই এই সামাজিক চাপ থেকে বের হওয়া যায় সহজেই। শুধু চর্চাটা শুরু করা দরকার। জীবনতো একটাই। নিজের মত করে নিজের জীবনটা উপভোগ করলে ক্ষতি তো নেই। সমাজের এসব চাপকে প্রশ্রয় না দিয়ে একজন ভালো মানুষ হওয়ার দিকে নজর দিলে সব চাপের প্রশমন ঘটতে পারে। না হয়, হল না ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। সমাজের কোন পেশাই তো ছোট বা তুচ্ছ নয়।
এই পেশা বড়, ওই পেশা ছোট এসব কে নির্ধারণ করলো? এর মাপকাঠিই বা কী? সকল পেশাকে সম্মান করলে এসব সামাজিক চাপ মাথায় নিতে হতো না কোনো মানুষের। জীবনটাকে জীবনের গতিতে চলতে দেয়াই সমীচীন। মানব জীবনপথের দৈর্ঘ্য খুব বেশি বড় নয়। কিছু বছর মাত্র। জীবনের বেশিরভাগ সময় যদি প্রতিযোগিতায় সঁপে দিয়ে সামাজিক চাপে পিষ্ট করে ফেলি তাহলে এত সুন্দর পৃথিবী, এত মনোহর উপাচারগুলোকে উপলব্ধি করে এর প্রকৃত নির্যাস গ্রহণ করা হবে না কখনই।
জীবনের প্রতিটা স্তরের বা বয়সের আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। একজন মানুষ তার বয়স, আগ্রহ, ইচ্ছা,সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে জীবনটাকে সাজালেই জীবন হবে সার্থকমণ্ডিত। সামাজিক চাপ থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত ভালো কাজে ব্যয় করে জীবনটাকে আনন্দময় ও উপভোগ্য করে তোলা হোক সকলের প্রত্যয়। ইতিবাচক চিন্তা– ভাবনায়, সৃষ্টিশীলতায় নিবিষ্ট হয়ে নিজেকে একজন মননশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা অনেক বেশি অর্থপূর্ণ এবং যৌক্তিক।