ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেছেন, ‘অপরাধের ক্ষেত্রে সাইবার অপরাধ আমাদের দেশে নতুন ট্রেন্ড। দেশে অপরাধের তিনটি চ্যালেঞ্জ লক্ষ্য করেছি। এগুলো হচ্ছে জঙ্গিবাদ, মাদক আর তৃতীয়টি সাইবার অপরাধ।’
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। এর ফাঁদ থেকে বাঁচতে হলে নিজের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিজেকেই গড়ে তুলে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। গত ১৩ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘সাইবার অপরাধীরা বেপরোয়া, প্রতিদিনই ঘটছে নানান অঘটন’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার ওয়েবসাইট ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারের ফলে প্রতিদিনই নানান অঘটন ঘটছে। সাইবার অপরাধীরা দিনে দিনে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। নগর গোয়েন্দা শাখা, কাউন্টার টেরোরিজমসহ সিএমপির কয়েকটি থানায় এ সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ পত্র জমা পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল ও সচেতনতার অভাবেই সাইবার ক্রাইমের প্রবণতা বাড়ছে। পুলিশ বলছে, কেউ খুন করছে শারীরিকভাবে, আবার সাইবার ক্রিমিনালরা খুন করছে মানসিকভাবে। স্মার্টফোন এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ার পর থেকে আশঙ্কাজনকহারে অনলাইনে নারীদের হয়রানির ঘটনা বেড়ে গেছে। আর এর প্রধান ‘টার্গেট’ কিশোরীরা। তবে জঙ্গিরাও এই মাধ্যম ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ ও হুমকি দিচ্ছে। এই মাধ্যম ব্যবহার করছে প্রতারকরাও।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের প্রবণতা’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে ভার্চুয়াল জগৎ ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১১ ধাপে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ৭.৪৪ শতাংশ মানুষ। আবার অনলাইনে কাজ দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার শিকার হচ্ছে ১.৪০ শতাংশ ব্যবহারকারী। ছবি বিকৃত করে ১৫.৩৫ শতাংশ ব্যবহারকারীর ছবি অনলাইনে প্রচার করা হচ্ছে। অন্যদিকে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ৬.০৫ শতাংশ ব্যবহারকারী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২২.৩৩ শতাংশ মানুষ অপপ্রচার চালাচ্ছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট হ্যাক বা তথ্য চুরি হচ্ছে ০.৪৭ শতাংশের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং ও তথ্য চুরি হচ্ছে ১৫.৩৫ শতাংশের। অনলাইনে ১৭.৬৭ শতংশ ব্যবহারকারীকে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ১.৪০ শতাংশ ব্যবহারকারীর ভুয়া আইডি তৈরি হচ্ছে, ই-মেইলের মাধ্যমে তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সাধারণত ১৮ থেকে শুরু করে ৩০ বছর বয়সীরাই সাইবার অপরাধের শিকার বা ভুক্তভোগী। সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগী বেশির ভাগ নারীই (১৬.৩ শতাংশ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের শিকার। এ ছাড়া ১৪ শতাংশ নারী অনলাইনে পাঠানো বার্তায় হুমকি পান। ১১.২ শতাংশ নারীর ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু হয়রানির শিকার হয়েও ৮০.৬ শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাইবার অপরাধ দমনের জন্য বাংলাদেশের যে প্রস্তুতি থাকার কথা ছিল তা নেই। একই সঙ্গে এ জন্য পর্যাপ্ত রিসোর্স, দক্ষ জনবল এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর দুর্দান্ত অভাব রয়েছে। সাইবার অপরাধকে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট সক্ষমতাও নেই। পুলিশ বিভাগ, সিআইডি এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম দেখছে। কিন্তু এদের সাইবার অপরাধ নিয়ে বিশেষায়িত প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম উন্নত করার কাজ আরও আগে করা উচিত ছিল। তাদের মতে, সাইবার অপরাধ দমনে দরকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তাহলে কমবে সাইবার অপরাধ। এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদেরও সতর্ক থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ফেসবুকের পাসওয়ার্ড প্রদান এবং সামাজিক মাধ্যমে কিছু শেয়ার করার বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে চরম অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে। তাই পরিচয় যাচাই না করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ না করার জন্যও বলা হয়েছে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে অপরাধীদের প্রতিরোধ ও ব্যক্তি সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের সন্তানদের মূল্যবোধ জাগ্রত করতে শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে সন্তানরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কখন, কার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে। এ ছাড়া আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করে অপরাধ দমনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে।