ইচ্ছে ছিল আজকে অন্যকিছু লিখব, কিন্তু বিবেকের তাড়নায় লিখে ফেললাম সামপ্রতিক ঘটে যাওয়া বার্তা। চারিত্রিক অবক্ষয়, মানবিকতার অধপতন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? ধর্ষণের হাত থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ছাত্রী থেকে শুরু করে চার-পাঁচ বছরের শিশু পর্যন্ত কেহই রেহাই পাচ্ছে না। বেশীর ভাগ শিশু কিশোরী ধর্ষিত হচ্ছে তাদের শিক্ষক, নিকট আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের দ্বারা। চিন্তা করুন কত অমানবিক হলে একটা অবুঝ শিশু যে মা ছাড়া কিছুই বুঝে না তাকে ধর্ষণ করে গলা টিপে হত্যা করে কবর দিয়ে দেয়। এখন জিজ্ঞাসা মা, বোন, কন্যা শিশুরা কী ইজ্জত নিয়ে বাস করতে পারবে না? প্রতি পরিবারে শঙ্কা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় যাবে? কোথায় পাবে নিরাপত্তা? এমনকি ঘরের ভেতরেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। সাধারণ নাগরিক যারা শান্তি প্রিয় একটু খেয়ে পড়ে বাঁচতে চায় তাদের ইজ্জত নিয়ে বেঁচে থাকা দায় হয়ে গেছে। সামাজিক অবক্ষয় আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেকেছে। এ হায়নার দল, নেকড়ের দল কোথা পেল এই শক্তি? এই দুস্কৃতিকারীদের কোন দল নেই। তারা লম্পট, তারা মাদকাসক্ত দানব, সমাজের নিকৃষ্ট, ধিকৃত ব্যক্তি। ধর্মযাজক, মাদ্রাসা শিক্ষক, স্কুল শিক্ষক, অন্যান্য বয়সের লোকজন এই অমানুষদের কাতারে সামিল হয়েছে। এ হায়নার দল মানুষ থেকে অমানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এদের কিছুতেই ছাড় দেওয়া যাবে না। এদের বিচার হতেই হবে দ্রুত বিচার আইনে। নারী ও শিশু নির্যাতকদের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দ্রুত হ্রাস পাবে। আমরা ঘাতকদের শাস্তির দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার অক্লান্ত পরিশ্রমে, বিচক্ষণতায় এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে এই করোনা মহামারিতে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি পদে পদে তার সামনে হাজার সমস্যা। এইগুলির মোকাবিলায় রাত দিন কাজ করে যাচ্ছে। অথচ এই অবক্ষয়ের কারণে সব ম্লান হতে বসেছে। সামপ্রতিক ঘটনা দৃষ্টিতে মনে হয় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ আগের সব ঘটনাকে পিছনে ফেলে মহামারীতে রূপ নিয়েছে। তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সমাজের প্রভাবশালীদেরও এটাকে থামানোর ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে। ওয়ার্ড ভিত্তিক, এলাকা ভিত্তিক, উপজেলা পর্যায়ে, শহর, মহল্লায় নারী নির্যাতনকে প্রতিরোধ করার জন্য সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সর্বত্রই ধিক্কার জানাতে হবে এদের যেন সমাজে কোথাও জায়গা না হয়। ইদানীংকালে গণধর্ষণ একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সচেতন নাগরিকগণের গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে ধর্ষকরা এ সাহস কোথা থেকে পায়? অপরাধের ভয়ে অভিভাবকরা কোন অভিযোগ করতে সাহস পায় না। এমনকি মুখ খুলতেও পারে না। এরা এত দুর্ধর্ষ ও বেপরোয়া যে মায়ের সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে একটুও কুন্ঠাবোধ করে না। এমনকি নিজ ঘরে নারীকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালায়। এই সমস্ত লোমহর্ষক ঘটনাগুলি দেশে বিচারহীনতা ও বিচার দীর্ঘসূত্রতার কারণে হচ্ছে। এটা দৃঢ়ভাবে বলা যায়, যারা এদের বাঁচাতে আসে তাদের চিন্তা করা উচিত তাদেরও মা, বোন, কন্যা আছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় এ লম্পটদের কারণে প্রতি বৎসরে কত শত শত মেয়ে উপায়ান্তর না দেখে আত্মাহুতি দিচ্ছে। এরা কারোনা কারও সন্তান। যে দেশে অপরাধীর বিচার হয় না, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে সে দেশে মানুষ বাস করতে পারে না। আদিকাল থেকে যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার ঘটনা ঘটে আসছে। সবাই সেটা জানে। তবে সেগুলি লোক চক্ষুর অন্তরালে। গত কয়েকদিন থেকে বিভিন্ন সংস্থা, দল এবং জোট ধর্ষণের প্রতিবাদে রাস্তায় সমাবেশ করে, আন্দোলনে নেমে এসেছে। তারা ব্যক্ত করেছেন তারা এই বাংলাদেশ দেখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেনি, তারা বলতে চায় ৩০ লক্ষ লোকের প্রাণের বিনিময়ে এবং ৩ লক্ষ মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি সেটা কিছুতেই কলুষিত হতে দেবো না। এটুকু অনুভব করার বিষয়, যে মেয়েটা ধর্ষিত বা নির্যাতিত হল তার তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থা কী দাঁড়াবে ভাববার বিষয়। ছাত্রী হলে শিক্ষা জীবন সেখানেই শেষ। ভবিষ্যৎ জীবন হয়ে উঠবে অভিশপ্ত। সমাজে আর দশজনের মত সে বাস করতে পারবে না। তার সাথে পুরো পরিবার সদা বিষন্নতায় ভুগবে। এ ধর্ষণ মহামারীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নিকোলাস গ্রোথ বলেছেন ধর্ষণ এক ধরণের বিকার। ক্রোধ এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছা থেকে ইহার সৃষ্টি হয়। আমেরিকান লেখিকা ডায়না বলেছেন একজন ব্যক্তি তখনই ধর্ষণ করে যখন সে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। যেহেতু শাস্তির ভয় থাকেনা, সামাজিকভাবে তার তেমন সমস্যা হয় না তাই বার বার সেটা ঘটাতে থাকে। যুগের আবর্তনে কিশোর, যুবক থেকে শুরু করে সব বয়সী লোকদের হাতে স্মার্ট ফোন। এই স্মার্ট ফোনের বদৌলতে কিশোর, যুবকদের যৌনতা প্রভাবিত হচ্ছে। তার সাথে পর্নোগ্রাফী এই যৌনতাকে উস্কে দিচ্ছে। একটা সুসংবাদ হলো দুই-এক বৎসর আগেও যে এসিড সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছিল সেটাকে দমন করার জন্য মৃত্যুদন্ডের মত শাস্তির বিধান করাতে সেটা একেবারেই কমে গেছে। আশা করি ধর্ষণ সন্ত্রাসও কমে যাবে। আমরা সেই আশায় রইলাম। শিল্পায়নে আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ঝলকে মানুষ সব ইন্দ্রিয়কে সংযত করতে না পারলেও আলো আঁধারের পার্থক্যটা মানুষ বুঝতে পারে। তাই প্রত্যেককে খেয়াল রাখতে হবে আমরা সবাই মিলে এমন কোন বিশ্বকে রেখে যাব না বা পাঠ্যবইয়ে এমন কিছু থাকবেনা যা পড়ে আগামী প্রজন্ম শঙ্কিত বোধ করে।
লেখক : প্রাক্তন চীফ এনাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।