অপরাধ এবং অপরাধমূলক ঘটনা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ। পুলিশের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, গত বছর ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় সংঘর্ষ, সংঘাত, হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে নির্বাচনী সহিংসতার ৭৫২টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৭ জন। আহত হয়েছে দুই হাজার ৫৩৪ জন। গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১০০ জনের বেশি। গৃহ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৪৫০টি। গাড়ি ও যানবাহন ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১০০টি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের ১২টি জেলায় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর হামলা, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। চলতি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি আরো নাজুক হওয়ার আশঙ্কা করছে পুলিশ সদর দপ্তর। এরই মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে দেশের সব পুলিশ সুপারকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পাশাপাশি কেউ যেন সামাজিক অস্থিরতাকে ব্যবহার করে গুজব ছড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক নজর রাখতে বলা হয়েছে।’ বিশ্লেষকরা বলেন, এক শ্রেণির মানুষ পুলিশ প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধ– কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সামান্য কারণেই খুনের ঘটনা ঘটছে। সমাজ, পরিবার বা প্রতিবেশীর সুসম্পর্ক কমছে। তাঁরা বলেন, ‘দেশে বিচ্ছন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বাইরে প্রতি বছর ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রে প্রাণ দিতে হচ্ছে গড়ে ক’হাজার মানুষকে। সরকারি হিসাবে কম হলেও খুন হচ্ছেন বহু মানুষ। এ কেবল সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও বিপজ্জনক। আরও উদ্বেগের বিষয় বেশ ক’জন সংসদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ আছে। যেমন–খুন, ধর্ষণ, অপহরণ,জমি–সম্পত্তি–অর্থলুট। এই ব্যাধি সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদ, দেশি–বিদেশি বৃহৎ ধনী,পুলিশ প্রশাসনের উচ্চস্তরের মধ্যে যে লুটেরা–জোট গড়ে উঠেছে, সেটা দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কাজের ফোয়ারা ছুটিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র।’
কেন বাড়ছে এমন অপরাধমূলক ঘটনা? বিশেষজ্ঞরা তার মূল কারণ হিসেবে বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, সম্পদের লোভ, বেকারত্ব, ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তিতে পর্নোগ্রাফির প্রসার ও সহজলভ্যতা, বেপরোয়া জীবনযাপন, পাচার, কর্তৃত্বের বিরোধ–শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাবে সমাজের বিবেক বর্জিত কতিপয় নোংরা মস্তিষ্কের লোক নৃশংস আচরণে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তাই এসব অপরাধ বা নৃশংসতা বন্ধ করতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার অভাব ও বিকৃত মানসিকতার কারণে এমন নির্মমতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। পাশাপাশি মানসিক অস্থিরতা, স্বামী–স্ত্রীর পরকীয়ার কুপ্রভাব ও মাদকাসক্তির কারণেও সর্বস্তরে এমন ঘটনা ঘটছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশকে সবসময় সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন যে পাল্টেছে এবং সাইবার অপরাধ যে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে এই অপরাধ দমনে সক্রিয় হতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দেন সরকারপ্রধান। প্রধানমন্ত্রী পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, মানুষের সেবা দেওয়া, মানুষের জীবন মান উন্নত করা–এটাই হচ্ছে আমাদের সব থেকে বেশি প্রয়োজন। এবং সেদিকে আমাদের পুলিশ বাহিনী যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে এবং আমাদের প্রশিক্ষণ শুধু দেশে না, আমরা বিদেশে পাঠিয়েও এখন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, বিত্ত–বৈভবের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন কোথাও কোথাও দুর্বল বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই বন্ধন সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে অপরাধ অনেক কমে যাবে। তাঁরা বলেন, সামাজিক অপরাধ দমনে সমাজ, সম্প্রদায় ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে কার কী ভূমিকা, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
সমাজ অপরাধমুক্ত করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বিকল্প উপায় খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, শুধু শাস্তি দিয়ে অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। অপরাধ বন্ধ করতে শাস্তির পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।