সাজেকে আগুনে ২শ মানুষের ‘সব শেষ’

খোলা আকাশের নিচে ত্রিপুরা-লুসাইরা, ভ্রমণে বাধা নেই, তদন্ত কমিটি যাচ্ছে আজ

রাঙামাটি প্রতিনিধি | বুধবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালি উপত্যকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রিসোর্টকটেজ মালিকদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন রুইলুই পাহাড়ের লুসাইত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা। পুড়ে যাওয়া ৯৮টি স্থাপনার মধ্যে ৩৬টি ছিল লুসাইত্রিপুরাদের বসতবাড়ি। গত সোমবার দুপুরে আগুনের ঘটনায় এসব পরিবারের সবার রাত কাটছে খোলা আকাশের নিচে, কেউ কেউ কাটিয়েছেন গির্জা, মন্দির বা উপসনালয়ে। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের চোখেমুখে ক্ষতির ছাপ। মুহূর্তের মধ্যে সব হারানো পাহাড়িরা এখন ভাবছেন কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসন, সাজেক রিসোর্ট ও কটেজ মালিক সমিতির তথ্য মতে, আগুনে লুসাই জনগোষ্ঠীর ১৬টি ও ত্রিপুরাদের ২০টিসহ মোট ৩৬টি বসতঘর পুড়ে গেছে। ৩৬ পরিবারের প্রায় দুইশর কাছাকাছি মানুষ এখন বাসস্থান সংকটে। সাজেকের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মিঠুন ত্রিপুরা বলেন, আমাদের বাড়িঘর যা ছিল এখন সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘরে ধান ছিল, সব পুড়ে গেছে। আমরা এখন কী যে খাব, খাওয়ার মতো আর কিছু নেই। ঘরের পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো দেখে খোলা আকাশে নিচে সারারাত কাটিয়েছি। চিন্তায় ঘুমাতে পারিনি।

আরেক ক্ষতিগ্রস্ত রঞ্জন ত্রিপুরা জানান, তিনি ঘর থেকে কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। ঘর পুড়ে গেছে। সব হারিয়ে তিনি এখন কাঁদছেন। চেয়েছেন প্রশাসন ও সরকারের সহযোগিতা।

ক্ষতিগ্রস্ত লেবিট লুসাই বলেন, এখানে যেসব বাড়িঘর পুড়ে গেছে সব আমরা আত্মীয়স্বজন। একেকজনের একেক রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেকের আদা, আবার অনেকের হলুদ পুড়ে গেছে। এখন রাস্তায় থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।

১৬৭ নম্বর রুইলুই মৌজার হেডম্যান লাল থাঙ্গা লুসাই বলেন, সাজেকে এত বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। আমার ঘর বিল্ডিং হওয়ায় পুড়ে গিয়ে একদম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। থাকার মতো অবস্থা নেই।

এদিকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের সাময়িক সহায়তায় এগিয়ে এসেছে সাজেক কটেজ ও রিসোর্ট মালিক সমিতি। সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিজয় ত্রিপুরা বলেন, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়দের সমিতি এবং আশপাশের পাড়ার লোকজন মিলে সোমবার রাতে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে পরনের কাপড় যা ছিল তা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। স্যান্ডেল পরার সুযোগ পাইনি। আগুনের লেলিহান শিখা মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। গায়ে যা আছে তা দিয়ে পরিবার নিয়ে খোলা আকাশে রাত কাটিয়েছি। তিনি জানান, সেনাবাহিনী ও পাড়ার আশেপাশের স্থানীয় লোকজন তাদের খাবার দিয়ে সহযোগিতা করছেন। যাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে তারা অনেকে খোলা আকাশে, অনেকে মন্দিরগির্জায় রাত কাটিয়েছে।

সাজেক ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অনিত্য ত্রিপুরা জানান, সোমবার থেকে আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ, সাজেক কটেজ মালিক সমিতি মিলে খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তরা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে। ত্রিপুরা, লুসাই জনগোষ্ঠীর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। জুম চাষ, হলুদ চাষ করে তাদের জীবন চলে। এখন নিঃস্ব মানুষের সহায়তায় সরকার ও বিত্তবানরা এগিয়ে এলে তারা কিছুটা উপকৃত হবেন।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সাজেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ৯৮টি রিসোর্টকটেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত ও ভস্মীভূত হয়েছে। এর মধ্যে কটেজ ৩৫টি, বসতঘর ৩৬টি, রেস্টুরেন্ট ৭টি ও দোকান ২০টি। এর মধ্যে ৯৮টি প্রতিষ্ঠান ও বসতঘরের জন্য ১৫ লাখ ১০ হাজার অর্থ বরাদ্দ ও ১ হাজার ৮০ কেজি চাল (খাদ্যশস্য) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতি পরিবার সাড়ে ৭ হাজার টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল পাবে এবং প্রতি প্রতিষ্ঠান ২০ হাজার টাকা করে পাবে।

রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, সরকারি মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন গাইডলাইন ২০১২১৩ অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবার সাড়ে ৭ হাজার টাকা ও ৩০ কেজি চাল এবং প্রতি প্রতিষ্ঠানের জন্য ২০ হাজার টাকা সহায়তা সাজেকের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছি। বুধবার ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে হস্তান্তর করা হবে।

তবে অর্থ ও খাদ্যশস্য বরাদ্দ অনেক কম হয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকসুজনের রাঙামাটির সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার। তিনি বলেন, ২০২৫ সালে এসেও অর্থ ও খাদ্যশস্য সহায়তার ক্ষেত্রে সরকার এখনো ২০১২১৩ সালের গাইডলাইন অনুসরণ করছে। দ্রব্যমূল্যের বাজারদরের সঙ্গে এটি যুগোপযোগী নয়। এটি যুগোপযোগী করার আহ্বান জানান তিনি।

তদন্ত কমিটি যাচ্ছে আজ : অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ উদ্ঘাটনে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি আজ বুধবার ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রাঙামাটির স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মো. মোবারক হোসেন জানান, আজ তারা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করবেন। এই কমিটির সদস্য সচিব বাঘাইছড়ির ইউএনও শিরীন আক্তার। কমিটির ৩ সদস্য হলেন রাঙামাটির সহকারী পুলিশ সুপার (বাঘাইছড়ি সার্কেল), রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (দীঘিনালা) সহকারী প্রকৌশলী।

সাজেক যেতে বাধা নেই : সোমবার রাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাজেক ভ্যালিতে পর্যটকদের ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হলেও গতকাল দুপুরে সেটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এতে করে পর্যটকদের সাজেক ভ্যালি যেতে বাধা নেই। গতকাল দুপুরে রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (এডিএম) পাঠানো এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহত্যা, ধর্ষণের বিচার দাবিতে গণঅনশন কর্মসূচি
পরবর্তী নিবন্ধসাদ মুসা গ্রুপের এমডির ৫ বছরের কারাদণ্ড