শেষ হয়েছে ২২ দিনের প্রতীক্ষা। নতুন স্বপ্ন নিয়ে গত শনিবার থেকে সাগরে পাড়ি জমায় জেলেরা। সাগরে চলছে মাছ ধরার উৎসব। এতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে ট্রলার মালিক ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে কঙবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে।
ইতোমধ্যে উপকূলের কাছাকাছি মাছ ধরতে নামা কিছু ট্রলার ফিরতে শুরু করেছে কঙবাজার ফিশারি ঘাটে। তবে ট্রলারগুলো ইলিশ ছাড়া ছোটবড় হরেক রকমের মাছ নিয়ে ফিরছে। ইলিশ ধরার ট্রলারগুলো ঘাটে পৌঁছাতে আরও ৪ থেকে ৫ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন জেলেরা। ঘাটে আসা বেশির ভাগই আইড় মাছ (গুইজ্যা), পোপা, ছুরি, লইট্টা, ফাইস্যাসহ বিভিন্ন ছোট প্রজাতির মাছ।
গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিনে বাঁকখালী নদীর মোহনায় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোর থেকে একের পর এক মাছ ভর্তি ট্রলার ভিড়ছে ঘাটে। আড়তগুলোতে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বইছে। মৎস্য ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের যেন দম ফেলার সময় নেই। কয়েকদিন আগেও যেখানে ছিল সুনসান নিরবতা, সেই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এখন মানুষের কোলাহলে মুখর। জেলে, শ্রমিক, ব্যবসায়ীদের হাঁকডাকে সরগরম পুরো এলাকা।
ফিশারি ঘাটের ব্যবসায়ী শফিউল আলম বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে সবেমাত্র ট্রলারগুলো ইলিশ ধরতে গেল। ইলিশ নিয়ে আসতে আরও ৪/৫ দিন সময় লাগবে ট্রলারগুলোর। আমরাও ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে যাওয়া জেলেদের ফিরে আসার অপেক্ষা করছি। বড় বড় ইলিশ নিয়ে ট্রলারগুলো ফিরলে আমরা ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হতে পারবো বলে আশা করছি। ঘাটে ফেরা ‘এফবি মায়ের দোয়া’ ফিশিং ট্রলারের জেলে রাশেদ নূর বলেন, বেশিরভাগ ট্রলার শুক্রবার দুপুরের পর রওনা করেছে। সোমবার দুপুরে ফিশারিঘাটে ১০ থেকে ১২টি ট্রলার ভিড়েছে। তবে ইলিশ নিয়ে এখনো ট্রলার ঘাটে পৌঁছায়নি। ইলিশের ট্রলারগুলো আরও পরে আসবে। আমরা ছোটবড় নানান জাতের মাছ নিয়ে ঘাটে ফিরে এসেছি।
ট্রলার মালিকেরা জানান, বঙ্গোপসাগরের কঙবাজার সমুদ্র উপকূলে বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। এর মধ্যে ইলিশ জাল বা ভাসা জালের বোটগুলো পক্ষকালের রসদ নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। এছাড়া ফইল্যা জালের বোটগুলো ৫ থেকে ৬ দিনের রসদ নিয়ে মাছ ধরতে যায়। তবে চাউপ্পা জাল, ডোবা জাল, চামিলা জাল ও চোখফুলা জালের বোটগুলো মাত্র একদিনের রসদ নিয়ে সাগরে যায় এবং মাছ ধরে দিনে দিনেই ফিরে আসে। এই ধরনের জালের বোটগুলো সাগর উপকূলে ছোট প্রজাতির মাছ ধরে, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘পাঁচকাড়া’ (পাঁচ প্রকারের) মাছ বলা হয়।
বোটগুলোতে একেক মৌসুমে একেক প্রজাতির মাছ বেশি ধরা পড়ে। এখন ধরা পড়ছে পোয়া, ফাইস্যা, চোখফুলা, অলুয়া, কামিলা ও কৈ পুটি মাছ। এছাড়া ককশিটের বোটগুলোও একই ধরনের জাল নিয়ে মাছ ধরতে যায়। এই ইঞ্জিনবিহীন বোটগুলো প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বার সাগরে আসা যাওয়া করে।
দরিয়ানগর বোট মালিক সমিতির সভাপতি নজির আলম বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে সাগরে মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। এরপর দরিয়ানগর ঘাট থেকে ফইল্যা জাল, চাউপ্পা জাল, ডোবা জাল, চামিলা জাল ও চোখফোলা জাল নিয়ে ছোট আকারের ইঞ্জিন বোটগুলো সাগরে মাছ ধরতে নেমেছে। এর মধ্যে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ককশিটের বোটগুলো কয়েক দফায় মাছ ধরে ঘাটে আসা যাওয়া করেছে।
জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার মোস্তাক আহমদ বলেন, বছরে প্রায় ৫ মাস বসে থাকতে হয় জেলেদের। বর্ষা মৌসুম ও দুর্যোগ মানে আরও দুর্গতি। তাই জালে মাছ ধরা পড়লেই সবার মাঝে স্বস্তি বিরাজ করে। ফিশারিঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী বলেন, ইলিশের প্রজনন মৌসুম উপলক্ষে মাছ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর দেশের অন্যতম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র একদমই ফাঁকা ছিল। শুক্রবার থেকে সাগরে মাছ ধরা শুরুর পর জেলে পল্লীগুলোতে আবারও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান বলেন, কঙবাজার উপকূলে ইলিশ ধরা মৌসুমে জেলেরা নিষেধাজ্ঞা মেনে সাগরে যায়নি। এতে সাগরে ইলিশ প্রজনের পাশাপাশি অন্যান্য মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। জেলায় ছোটবড় মাছ ধরা ট্রলার আছে প্রায় সাত হাজার। এসব ট্রলারে জেলে শ্রমিক দেড় লাখেরও বেশি। নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন প্রায় ২৪ হাজার জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে।