গভীর বঙ্গোপসাগরে আগামী মাস থেকে টুনা মাছ শিকার শুরু হচ্ছে। টুনাসহ সমজাতীয় পেলাজিক মৎস্য আহরণের জন্য ২৪ কোটি টাকায় কেনা দুইটি জাহাজের একটি আগামী মাসে চট্টগ্রামে পৌঁছাবে। দেশের ১৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে টুনা মাছ শিকারের অনুমোদন দেয়া হলেও কেউ এগিয়ে না আসায় সরকারই টুনা মাছ শিকারের কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টুনা মাছের বিশাল বাজার রয়েছে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, ভারত, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপসহ ধারে কাছের দেশগুলো এই খাত থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করে। সাগরের গভীরে গিয়ে মাছ শিকারের উপযোগী জাহাজ কেনার সরকারি এই উদ্যোগ ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়নে বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বঙ্গোপসাগরের ১. ১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন থাকলেও বাংলাদেশ মাত্র ২৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা থেকে মৎস্য আহরণ করতে পারে। উক্ত ২৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে চারটি পৃথক অঞ্চলে ভাগ করে বাংলাদেশের জাহাজগুলো মাছ শিকার করে। ১০০ মিটারের বেশি গভীরতায় মাছ শিকারের সক্ষমতা বাংলাদেশী জাহাজগুলোর নেই বললেই চলে। প্রতিবেশি এবং ধারে কাছের দেশগুলোর মধ্যে ভারত, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তান গভীর সাগর থেকে প্রচুর টুনা মাছ শিকার এবং বিদেশে রপ্তানি করে। বাংলাদেশের অধরা থেকে যাওয়া বঙ্গোপসাগরের এক্সক্লুইভ ইকনোমিক জোন এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনাসহ পেলাজিক মাছের বিশাল ভান্ডার রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই ধারণা থেকে টুনা মাছ শিকারের জন্য দেশের ১৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মাছ শিকারের অনুমোদন দেয়া হয়। যারা নিজেরা জাহাজ কিনে মাছ শিকার করার কথা ছিল। কিন্তু এক একটি জাহাজে বিশাল বিনিয়োগ এবং সুনির্দিষ্ট কোন জরিপ না থাকায় দীর্ঘদিনেও কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টুনা মাছ শিকারের উপযোগী জাহাজ ক্রয় করেনি। ফলে মৎস্য অধিদপ্তরের উদ্দেশ্য মাঠে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। এই অবস্থায় বাংলাদেশ মৎস অধিদপ্তর নিজেরাই জাহাজ কিনে টুনা মাছ শিকার এবং জরিপের উদ্যোগ নেয়।
মৎস অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৬১ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনটি জাহাজ কেনাসহ আনুষাঙ্গিক কাজের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ডলার সংকটসহ নানা প্রতিকূলতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে ৫৫ কোটি ২১ লাখ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। এতে তিনটি জাহাজের স্থলে দুইটি জাহাজ কেনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চীনের ইউনি মেরিন সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড নামের কোম্পানি থেকে জাহাজ দুইটি কেনা হচ্ছে। তাদের ইয়ার্ডে ইতোমধ্যে একটি জাহাজ তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। অপর জাহাজটির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী মাসেই একটি জাহাজ চট্টগ্রামে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ওই একটি জাহাজ দিয়েই টুনা মাছ শিকার শুরু করা হবে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় জাহাজটি পৌঁছালে সেটিকেও গভীর সাগরে মাছ শিকারে পাঠানো হবে। গভীর সাগরে টুনা মাছ শিকারের জন্য প্রাথমিকভাবে ৩০ জন ক্রু নিয়োগ দেওয়া ও প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টুনা মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বে। বাংলাদেশেও প্রচুর টুনা মাছ আমদানি হয়। তবে তা মাছ আকারে না এসে তা প্রক্রিয়াজাত করে ক্যানে করে আনা হয়। জাপান এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টুনা মাছের বিশাল বাজার রয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকভাবে সাগরের দুইশ’ মিটার গভীরে টুনাসহ অন্যান্য মাছ শিকারের জন্য জাহাজ পাঠানো হবে। বেসরকারি যে সব প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে তাদেরকে উৎসাহিত করতেই মূলত সরকার এই প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের জাহাজ টুনা মাছ শিকারে সফল হলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বেলাল হায়দার পারভেজ বঙ্গোপসাগরের গভীরে প্রচুর টুনাসহ পেলাজিক জাতীয় মাছের মজুদের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের এই উদ্যোগ বড় ধরণের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
মৎস্য আহরণের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, টুনা মাছ শিকারের যে উদ্যোগ তাতে এক একটি প্রতিষ্ঠানকে কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু কী পরিমান মাছ আছে বা রিটার্ণ কেমন হবে তার কোন সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই। তাই এই খাতে বিনিয়োগে কোন প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আসেনি। তিনি বলেন, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের সাউথ প্যাচেস, সাউথ অফ সাউথ প্যাচেস, মিডল গ্রাউন্ড এবং সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড– এই চারটি অঞ্চলে মাছ শিকার করা হয়। এসব গ্রাউন্ডে মাছ শিকারের জন্য যেতে উপকূল থেকে কমপক্ষে ১শ’ নটিক্যাল মাইল পাড়ি দিতে হয়। টুনা ফিশ শিকার করতে আমাদেরকে কমপক্ষে ৩৮০ নটিক্যাল মাইল দূরে যেতে হবে। ভারত এবং শ্রীলংকার কাছাকাছিতে থাকা বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ শিকার করতে যাওয়ার যে সক্ষমতা তা এখনো আমাদের নেই। তিন থেকে চারদিন জাহাজ চালিয়ে ওখানে পৌঁছাতে হবে। এতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ প্রয়োজন। রিটার্ণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আগে এত রিস্ক নিতে কোন বিনিয়োগকারীরই রাজি নন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সরকার যদি সফল হয় তাহলে অবশ্যই আমরাও বিনিয়োগে এগিয়ে আসবো।
উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির ২৬৩টি ফিশিং ভ্যাসেল রয়েছে। এর বাইরে ৭০ হাজারের মতো ট্রলার ও নৌকাও বঙ্গোপসাগরের ২৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মাছ শিকার করে। এসব জাহাজ এবং নৌকা বছরে ৬ লাখ টনেরও বেশি মাছ শিকার করে। বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলে ৪৭৬ প্রজাতির মাছ ও ৩৯ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।