সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচিত বিষয় হলো সাইবার নিরাপত্তা। কেননা, দেশে ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সাইবার হুমকি। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান কেউই এর বাইরে নয়। ভার্চুয়াল জগতে সাইবার নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এ ঝুঁকি দিন দিন আরো জটিল ও ব্যাপক হয়ে উঠছে। হ্যাকিং, ডাটা চুরি এবং অন্যান্য সাইবার নিরাপত্তা ব্যর্থতা বিশ্ব অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলছে। ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক জীবন বিষিয়ে তুলছে। সাইবার নিরাপত্তা এখন প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বড় অংশই কাটে সাইবার স্পেসে বা অনলাইনে। আবার প্রায় সব ধরনের কাজ ও পরিষেবাও এখন অনলাইননির্ভর। তাই ব্যক্তিগত তথ্য থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিংবা গ্রাহকের ডাটার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ।
পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইবার সিকিউরিটি ভেঞ্চারস অনুসারে বিশ্বব্যাপী সাইবার সিকিউরিটি চাকরির শূন্যপদ ৩৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন সাইবার নিরাপত্তায় চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। ডিজিটাল মুদ্রা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিস্তারের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তার গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে সাইবার নিরাপত্তা পেশাদারদের আয়ের সম্ভাবনাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ চাকরিজীবীর গড় বার্ষিক বেতন ছয় অংকের বেশি, যা এ ক্ষেত্রটিকে আর্থিক দিক থেকেও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। যদিও বাংলাদেশে একজন ফ্রেশার ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। অতীতে আইনজীবী, ডাক্তার, নার্স, ব্যাংকার এবং শিক্ষকতার মতো পেশাগুলো কর্মবাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এ পেশাগুলোর প্রধান আকর্ষণ ছিল চাকরির নিরাপত্তা। বর্তমানে নতুন শিল্প খাতগুলোয় প্রায়ই অনিশ্চয়তা দেখা যায়, কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা এখন ‘চাকরির নিরাপত্তা’–এর সমার্থক হয়ে উঠেছে। সাইবার নিরাপত্তা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম এবং এ চাহিদা আগামী দিনগুলোয় আরো বাড়বে। সাইবার নিরাপত্তা শিল্পে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য এখনই সঠিক সময়। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি, আর্থিক সুবিধা, চাকরির স্থায়িত্ব এবং বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা–সবকিছু মিলিয়ে সাইবার নিরাপত্তা ভবিষ্যতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রভাবশালী পেশাগুলোর মধ্যে একটি।
বিশ্ব আজ একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির মহাসড়কে অগ্রসরমান। যেখানে সাইবার নিরাপত্তা এখন এক অনিবার্য বাস্তবতা। বাংলাদেশও বর্তমানে এক রূপান্তরের পথে হাঁটছে তার স্বপ্ন পূরণের পথে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রা যেমন দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে আমূল পরিবর্তন আনছে, তেমনি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাইবার নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলোও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রযুক্তিখাতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেলেও সাইবার হামলার ঝুঁকি বাড়ছে। হ্যাকিংয়ের শিকার হচ্ছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এতে তাদের মারাত্মক আর্থিক খেসারত দিতে হচ্ছে। তবে আগাম সতর্কতা অবলম্বন করলে সাইবার হামলা থেকে সুরক্ষায় থাকা সম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যতটা দ্রুত ডিজিটাল হওয়ার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে সাইবার নিরাপত্তার দিকে ততখানি নজর দিচ্ছে না। অন্যদিকে দেশ দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের দিকে গেলেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তেমন দক্ষ বা সচেতন নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সাইবার স্পেস অনেকখানি ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে, আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টা। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৮০৮ কোটি টাকা ডিজিটাল পদ্ধতিতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা হয়। দেশি–বিদেশি নানা উদ্যোগের পরও এই টাকা এখনও পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আমাদের বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাত সাইবার নিরাপত্তার দিকে বিশেষভাবে নজর রাখা উচিত।
তাঁরা বলেন, সাইবার স্পেসকে নিরাপদ রাখার মূল চারটি পূর্ব শর্ত হলো: ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ। সরকার এই মূল চারটি পূর্বশর্তকে লক্ষ্য করে কাজ করে যেতে পারে বলে তাঁরা মনে করেন। সরকারকে সাইবার নিরাপত্তায় দক্ষ জনশক্তি তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। আগামীতে সক্ষম ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিজস্ব প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নে জোর দিতে হবে। এছাড়াও বিদেশি প্রযুক্তির অনুকরণ কমিয়ে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো সাইবার সিকিউরিটির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কাছে আগামী দিনগুলোতে সাইবার নিরাপত্তার ওপর প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য সেমিনার, কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করার কোনো বিকল্প নেই।