দেহ ও আত্মা এই দু‘টি সত্তা নিয়ে মানুষ। আমাদের পরিশ্রম, কর্ম এই সব আয়োজন যেন দেহের জন্য। সব চেষ্টা দেহ ঘড়িটাকে ভালো রাখার জন্য। একটু ভেবে দেখুন তো, শরীর ভালো রাখার জন্য আমরা ডাক্তারের কাছে যাই, আবার রূপ চর্চার করার জন্য যায় বিউটি পার্লারে। কিন্তু অন্তরকে ভালো ও পরিষ্কার রাখার জন্য কোথাও কি যাই? আত্মারও যে সুস্থতার প্রয়োজন হয়, সেটা আমরা অনেকেই মনে রাখি না। যেমন ধরুন, দেহ যদি গাড়ি হয়, তেমনি আত্মা সে গাড়ির ইঞ্জিন। সে ইঞ্জিনের জন্য যেমন জ্বালানির প্রয়োজন হয়, তেমনি কার্যক্ষম রাখতে তাকে পরিষ্কার –পরিচ্ছন্নও রাখতে হয়, এখানে আত্মার জ্বালানি হলো আধ্যাত্মচর্চা বা সুফিবাদ চর্চা। বিলাসবিহীন ও সরল জীবনযাপন, উচ্চতর চিন্তন এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে রক্ষাই হলো সুফিবাদ চর্চার আদর্শ।
বর্তমান সময়ে মানুষের মূল্যবোধের চরম অবনতি হচ্ছে। আর অনৈক্য হানাহানিতে আমরা জর্জরিত। তার উপর ধর্মীয় হানাহানি তো আছেই। বিশ্বখ্যাত সুফি ও মহাকবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রাঃ) বলেছেন, ‘আত্মা যদি শুদ্ধ হয়, হৃদয় যদি ঝকঝকে আর পরিষ্কার হয়, একটি স্বচ্ছ কাচের আয়নার মতো হয়, তাহলে সেখানে ঐশী বারতা আসবে। আমরা বলতে পারি, আমাদের নতুন নতুন বার্তা পাওয়ার জন্য চাই একটি বিশুদ্ধ অন্তর।’
বস্তুবাদী জীবন দর্শনের চরম উৎকর্ষতার এ যুগে জাগতিক উন্নতি ও জৈবিক চাহিদার সব আয়োজন পূরণ সত্ত্বেও মানব দেহের অভ্যন্তরে যে রূহ, তা নিত্য হাহাকার করছে নিদারুণ শূন্যতায়। তার ফলে খোদ পশ্চিমা দুনিয়ায় পারিবারিক অশান্তি ও অবিশ্বাস দাবানল জ্বলছে ঘরে ঘরে। সেই দাবানল হানা দিয়েছে আমাদের সমাজেও।
সুফিসাধকদের মতে, সুখ–শান্তি এমন এক রত্ন, যা না থাকলে মানুষের জীবন পরিণত হয় নরকে। প্রশান্তিহীনতা মানুষের অস্তিত্বকে তিলে তিলে অস্থির করে তোলে। আজকের পৃথিবীতে মানুষ বিচিত্র অশান্তি ও সংকটে নিমজ্জিত। তারপরও সবার একান্ত চাওয়া, যেকোনো উপায়েই হোক হারানো শান্তি ও সুখ পুনরায় ফিরিয়ে আনা। এভাবে সুখ–শান্তি অন্বেষণের উপায় নিয়ে বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন ফেরকা, মতবাদ ও নানা গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। এই সব থেকে পরিত্রাণের উপায় হতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রে সুফিচর্চা ছড়িয়ে দেওয়া। যাঁরা সুফিবাদে বিশ্বাসী তাঁরা মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ মানেন না, হিংসা–নিন্দা করেন না আর বিশ্বাস করেন না ধর্মের নামে আচার অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়ি ও গোঁড়ামি।
হযরত জাকারিয়া আল আনসারি (রাঃ) বলেনঃ ‘সুফিদর্শন আত্মার সংশোধনের শিক্ষা দান করে তার নৈতিক চরিত্রকে উন্নত করে। আত্মা পবিত্রতা বিধানই এর বিষয়বস্তু এবং লক্ষ্য চিরন্তন শান্তি।’
সুফিবাদ কিংবা সুফিচর্চার কথা বললেই চলে আসে বিশ্ব–প্রেমিক, সাধক কবি মওলানা জালালুদ্দিন রুমির(রাঃ) কথা। আধুনিক নরনারী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে রুমির প্রতি যে ঝোঁক দেখা যায় সেটা শুধু ভালোবাসার কারণেই। বিশেষ করে রুমির কবিতা পাশ্চাত্যে তরুণদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। কারণ তাঁর কবিতায় রোমান্টিসিজম যেমন আছে, তেমনি আছে গভীর আধ্যাত্মিকতা। এক গভীর ভাব রয়েছে তার কবিতার মধ্যে।
মানুষ এখন চরম ভোগবাদ ও অহংবোধে লিপ্ত। ঠিক এ জায়গাতেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে রুমির লেখনী ও দর্শন। যেখানে আত্ম–অহমিকা ও পার্থিব জড়বস্তু বিনয় ও আত্মা শক্তির কাছে সমর্পিত হয়। হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন, একজন ব্যক্তি কীভাবে পার্থিব সম্পদ ছাড়া বাঁচতে পারে? এ ক্ষেত্রে রুমির উত্তর হলো, এই পৃথিবী গঠন, রূপ ও রঙে সত্যিই পার্থিব জীবনধারণ ও বসবাসের জন্য একটি সুন্দর জায়গা। তবে যা এড়িয়ে চলতে হবে তা হলো অহংকার। সেইসাথে চরম ভোগবাদী চেতনা। যাঁরা সুফিবাদে বিশ্বাসী তাঁরা ভোগবাদী না হয়ে পরিমিত জীবনযাপনের উপর গুরুত্ব দেন বেশি। বর্তমানে আমরা এক অস্থির সময় পার করছি।
মহান আল্লাহ তায়া’লা কোরানে বলেছেন, ‘আমি তোমার শাহারগের নিকটেই আছি,’ আমি তোমার নফসের সঙ্গেই মিশে আছি, তুমি কি দেখছ না? ‘আমাকে ডাকো, আমি জবাব দেব।’ এবং হাদিস শরিফে আছে, মোমিনের হৃদয়ে আল্লাহর আরশ, ‘যে নিজেকে চিনেছে, সে প্রভুকে চিনেছে।’ কিন্তু আমরা তাঁর খোঁজ পাই না কেন? কারণ, আমাদের হৃদয়ের মধ্যে বিরাজ করছে ক্রোধ, ঘৃণা, ঈর্ষা, লোভ, মোহ, ভয়, ইচ্ছা– আকাঙ্ক্ষা সর্বোপরি আমিত্ব। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সাহাবিদের বললেন, ‘প্রতিটি মানুষের সাথে একটি শয়তান জুড়ে দেওয়া হয়েছে?’ “ইয়া রাসুলুল্লাহ, ‘বললেন এক সাহাবি,’ আপনার সাথেও কি শয়তান জুড়ে দেওয়া হয়েছে?’ হ্যাঁ, আমার সাথেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে, আমি তাকে মুসলমান বানিয়ে ফেলেছি।’ আর এই অন্তরের শয়তানকে মুসলমান বানানোই সুফির সাধনা।
এ পরিস্থিতিতে আমাদের সমাজকে, তথা গোটা মানবতাকে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে পথ দেখাতে পারে মওলানা রুমির মসনবী শরীফের বিশাল ভান্ডারে রক্ষিত প্রেম দর্শন।
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি সেসব মনীষীদের একজন, যিনি সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর সমগ্র রচনায় মানুষকে সঠিক জীবনযাপনের পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সুখ–শান্তি কেন চলে গেল, তা ফিরিয়ে আনার জন্য কী করা উচিত মসনভিতে এ সংক্রান্ত চমৎকার চমৎকার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, দেখিয়েছেন সঠিক রাস্তা এবং বাতলে দিয়েছেন সঠিক উপায়। মসনবি শরিফ রচনার ক্ষেত্রে রুমির লক্ষ ছিল যে, পাঠকদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত করে উন্নত জীবনযাপনের দিকনির্দেশনা দেওয়া। রুমির দৃষ্টিতে মানুষের অশান্তির অনেকগুলো কারণের একটি হলো, পার্থিব স্বার্থের মোহ। বহু মানুষ বিশ্বাস করেন, অশান্তি হলো – বাহ্যিক কর্মফল এবং সুযোগ–সুবিধা আর শান্তি সমার্থক।
সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করা আজ বিশ্বের সকল জাতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সহিংসতা দিয়ে সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না, প্রেম দিয়েই সহিংসতার সাথে লড়াই করা যায়। প্রেমই পারে সকল ব্যাধি নিরাময় করতে এবং ভঙ্গ হৃদয়ের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করতে। তবে সে প্রেম হতে হবে শুদ্ধ ও পবিত্র। যে প্রেম একজন মানুষকে সামপ্রদায়িকতা বর্ণবাদ, শ্রেণিভেদ ও লিঙ্গবৈষম্যের উপরে নিয়ে যায়।
লেখক: প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম।