একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনার মাধ্যমে বাঙালি জাতি আত্মসচেতন হয়ে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, কার্যালয়, আদালতসহ সবখানে বাংলা ভাষার প্রচলন হোক। কিন্তু তা হয়নি। এ রাষ্ট্রে মাতৃভাষার চর্চাই প্রধান হিসেবে গৃহীত হবে; জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন-গবেষণা হবে বাংলা ভাষাভিত্তিক- এটাই ছিল স্বাভাবিক। ব্রিটিশ, পাকিস্তানি আমলেও বাংলা ভাষার পে জনমত ছিল অন্য ভাষার প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ সেই প্রতিবাদ নেই। সচেতনতা নেই। যা হওয়া অনিবার্য ছিল। এ পরিণতি অপ্রত্যাশিত। দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার বিভাজনটা এখন তিন ধারার। মাতৃভাষার ভিত্তিতে অভিন্ন শিক্ষারীতি হওয়ার কথা ছিল। এসব ধারার শিক্ষা-ব্যবস্থা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করছে না। ঐক্যবদ্ধ করার বদলে আমাদের বিভক্ত করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিভক্তিটা মূলত সামাজিক ক্ষেত্রে বিভাজনের ফল। এতে সমাজে বাড়ছে শ্রেণী-দূরত্ব। বাড়ছে বৈষম্য।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা এখনও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার কিছু চ্যালেঞ্জও ছিল। সেজন্য বাংলায় বই লেখা এবং বিদেশি বই অনুবাদ করা দুটিরই দরকার ছিল। কাজগুলো গত বছরগুলোতে হয়নি। ফলে বাংলা ভাষায় উচ্চস্তরে শিক্ষা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চস্তরের অধিকাংশ বই-ই ইংরেজিতে লেখা। এটাও সত্য, সাহিত্য, প্রবন্ধ ও বিভিন্ন বিষয়ের বই বাংলায় প্রচুর লেখা হয়েছে। তবে মৌলিক ও উচ্চশিক্ষার জায়গাগুলোর জন্য বই লেখার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা আছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এতগুলো বছর পরও বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ তুলে ধরতে পারছি না। বিশ্বকে বাংলা সাহিত্যের একটি সামগ্রিকতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছি না। এ ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর।
ভাষা আন্দোলনে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন। তাঁদের রক্ত বৃথা যায়নি। বাঙালি রক্তের পলাশ কলি দিয়েছেন। তাদের ফুটেছে ভাষার ফুল হয়ে। তাঁদের এই আত্মত্যাগের কারণে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এতে সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারেন বাংলাদেশ নামে একটি দেশের কথা, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার কথা। এ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে বাঙালি জাতি লাভ করেছিল আত্মমর্যাদার চেতনা।
মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের প্রেরণা। আজো একুশের চেতনার সমাপ্তি ঘটেনি, আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, কিন্তু পাইনি অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি সামাজিক সাম্য। গড়তে পারিনি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, তাই প্রতি বছর মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদেরকে দারিদ্রমুক্ত, অভাবহীন সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের প্রেরণা দিয়ে যায়।