চিকিৎসা একটি মহান পেশা। অন্য পেশার সঙ্গে চিকিৎসা পেশার তুলনা হয় না। নিজেকে প্রকাশ করার এবং জীবনে বেঁচে থাকার অনেক পেশা থাকলেও সবচেয়ে মহান পেশা এবং উৎকৃষ্ট পেশা হিসেবে বিবেচিত চিকিৎসা সেবা। এই পেশায় মানুষের কাছে যাওয়া যায়, তাদের সেবা করার সুযোগ আছে। মানুষ যখন রোগাক্রান্ত হয়, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে, তখন চিকিৎসার মাধ্যমেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায়, আর তা চিকিৎসকের উছিলাই আরোগ্য হয়। রোগগ্রস্ত অবস্থায় মানুষ অসহায় দুর্বল থাকে। এই দুর্বল সময় চিকিৎসকই তার বড় অবলম্বন, বড় বন্ধু, অসহায়ের সহায়। এজন্যই চিকিৎসা সেবা মহান পেশা হিসেবে গণ্য। কিন্তু কতিপয় চিকিৎসকদের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা এবং নির্বিকার মনোভাবের জন্য পুরো পেশাটাই হয়ে পড়ছে প্রশ্নবিদ্ধ। সেজন্য অফিস সময়ে সরকারি হাসপাতালের কোনো চিকিৎসক বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যসেবার জন্য গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোনো কারণে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় থাকলে টাস্কফোর্স ও সংশ্লিষ্টদের অবগত করতে হবে। এছাড়াও হাসপাতাল/ডায়াগনস্টিক সেন্টার-ল্যাব/ক্লিনিকগুলোতে লাইসেন্স নিবন্ধন নম্বর স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। দৈনিক আজাদীতে গত ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত খবরে বলা হয়, সভায় টাস্কফোর্স কর্তৃক সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন/অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। ১৬ নভেম্বরের মধ্যে অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা ও প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে নানা সময়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। বিশেষ করে সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে বিতর্ক হয় বেশি। অভিযোগটি নতুন নয়। চিকিৎসকরা যে সরকারি হাসপাতালে নিজ নিজ দায়িত্বের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করেন, তা একপ্রকার ওপেনসিক্রেট। তাঁদের অধিকাংশের নজর প্রাইভেট চেম্বার বা ক্লিনিকের দিকে। ওখানে যেন সময় দিতেই বেশি মনোযোগী। কেননা তাতে কম সময়ে বেশি উপার্জন হয়। এজন্য বিভিন্ন সময় সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ২০০৮ সালে দেয়া একটি আদেশে সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোমসহ সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের চাকরিতে কর্মরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নিবন্ধিত চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারীদের অফিস সময়ে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়। নির্ধারিত অফিস সময়ে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদান করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানারও বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এ নির্দেশনা কার্যকর হয়নি এখনো।
আমাদের মনে রাখা জরুরি, চিকিৎসকদের একটু অবহেলা একটু অসতর্কতায় বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হতে পারে রোগীদের। তখন আল্লাহর দেয়া সুন্দর জীবন বিষাদময় হয়ে যায়। রোগীদের প্রতি এতটুকু আন্তরিকতা প্রদর্শন হলে তারা স্বস্তি পায়, আশ্বস্ত হয়। কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবার চিত্র দেখে হতাশ হতে হয়। সাধারণ মানুষ নানা সময়ে হয়রানির শিকার হয় ও বঞ্চিত হয় সু-চিকিৎসা থেকে। দেশের প্রতি মানুষের প্রতি যারা আন্তরিক, যাদের সেবা করার একান্ত মানসিকতা আছে, শুধুমাত্র তারাই এই মহান পেশা চিকিৎসা সেবায় আসার অধিকার রাখেন। তবেই দেশ, জাতি তথা মানুষের কল্যাণ হবে।
এ কথা বলা অনাবশ্যক যে, চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্ররা চিকিৎসা পেশার শুরুতে একটি শপথ নেন, যা তাদের শিক্ষক পাঠ করান। পবিত্র এ শপথ সত্যিকার চিকিৎসক এবং মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার মন্ত্র হিসেবে কাজ করে। জানা যায়, ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জেনেভা ডিক্লারেশন নামে যে সিদ্ধান্তটি দিয়েছে তাও চিকিৎসকদের প্রতি এক সুদৃঢ় দিকনির্দেশনা অর্থাৎ হিপোক্র্যাটসের শপথনামার পরিবর্ধিত রূপ। শপথ এক ধরনের দায়বদ্ধতা। কোনো যুক্তি দিয়ে যার হেরফের করা যায় না। কিন্তু অভিযোগ, চিকিৎসকরা এখন সেটি ভঙ্গ করে চলেছেন। অন্য পেশার সঙ্গে চিকিৎসা পেশাকে মেলানো যাবে না। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, চিকিৎসকরা তাদের শপথ অনুসরণ করবেন।
বিশেজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে সরকারি চিকিৎসকদের প্র্যাকটিস নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত দ্রুত। শুধু নির্দেশনা দিয়ে এখান থেকে পরিত্রাণ লাভ করা সম্ভব নয়। তারজন্য প্রয়োজন মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করা।