সরকারি গ্যাসে বেসরকারি ব্যবসা!

একটি কলোনিতে ৩ চুলায় ২০ পরিবারের রান্না প্রিপেইড মিটারের বাইরে সাড়ে ৪ লাখ চুলা অপচয় ও চুরি ঠেকাতে নতুন প্রকল্পে অর্থের খোঁজে কেজিডিসিএল

হাসান আকবর | রবিবার , ১৫ জুন, ২০২৫ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

একটি কলোনিতে চুলার লাইন রয়েছে ২টি, অথচ পরিবার রয়েছে ১৩টি। ওই ১৩ পরিবারের রান্নার কাজ চলে দুটি চুলাতে। বাকলিয়া এলাকার একটি কলোনিতে চুলা রয়েছে ৩টি, কলোনিতে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ২০টি। ওই ২০ পরিবার ৩টি চুলা দিয়ে রান্নার যাবতীয় কাজ সারেন। কলোনির মালিক ২টি বা ৩টি চুলার বিল দেন, অথচ ২০ পরিবার ভাড়ায় রেখেছেন। বিষয়টিকে ‘সরকারি গ্যাসের বেসরকারি ব্যবসা’ হিসেবে দেখছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। কিন্তু আইনগতভাবে এটা বন্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র প্রিপেইড মিটারই এই ব্যবসা বন্ধ করতে পারে। কিন্তু কেজিডিসিএল টাকার অভাবে প্রিপেইড মিটার নিয়ে বেশিদূর এগুতে পারছে না। ইতোমধ্যে নগরীতে দুটি প্রকল্পে প্রায় দেড় লাখ চুলাকে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হলেও বাইরে রয়ে গেছে আরো সাড়ে চার লাখ চুলা। দুটি প্রকল্পের একটিতে অর্থায়ন করে জাপানের জাইকা। অপরটি কেজিডিসিএল নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করে। এখন নতুন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ঋণদাতার খোঁজ করা হচ্ছে। দেশের আবাসিক খাতের গ্যাসের অপচয় ও চুরি ঠেকাতে প্রিপেইড মিটারের কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে সূত্র বলেছে, চট্টগ্রামে ব্যবহৃত মোট গ্যাসের ১৫ শতাংশ আবাসিকে ব্যবহৃত হয়; যার একটি বড় অংশ অপচয় হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আওতায় চট্টগ্রামে ৬ লাখের মতো আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। এসব গ্রাহকের চাহিদার যোগান দিতে প্রতিদিন গড়ে ৪০৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের যোগান দিতে হয়; যা চট্টগ্রামে প্রাপ্ত মোট গ্যাসের ১৫ শতাংশ। একটি পরিবারের রান্না করতে প্রতি মাসে একটি ডাবল বার্নার চুলায় অন্তত একশ ঘনমিটার গ্যাস লাগে। ডাবল বার্নার গ্যাসের জন্য প্রতি মাসে ফিক্সড বিল নেওয়া হয় ১০৮০ টাকা। সিঙ্গেল বার্নারের জন্য নেওয়া হয় ৯৯০ টাকা। একটি পরিবারের ব্যবহৃত গ্যাসের আনুমানিক হিসেব কষে এই বিল নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি চুলায় একটি পরিবার রান্না করলে এই বিল যথোপযুক্ত। ক্ষেত্রবিশেষে সরকার কিছুটা লাভবান থাকে। কিন্তু অধিকাংশ গ্রাহক নিজেদের চুলায় নিজেরা রান্না করলেও চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলোনিতে এক চুলায় ১০/১২ পরিবারের রান্নার কাজ চলে। বিশেষ করে বস্তি এলাকাগুলোতে এই অবস্থা ভয়াবহ। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব চুলা বন্ধ করা হয় না। বিভিন্ন স্ল্যাবে সময় ভাগ করে একেকটি পরিবার নিজেদের রান্নার কাজ সারে। এতে হাজার হাজার টাকার গ্যাস পুড়লেও সরকার বিল পায় এক চুলার। চড়া দামে আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে এই ধরনের অপচয়ের যোগান দেওয়া কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।

গ্যাস অপচয় ও চুরি রোধ করতে কেজিডিসিএল আবাসিক খাতে গ্যাসে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করে কয়েক বছর আগে। প্রথম প্রকল্পের আওতায় নগরীতে ৬০ হাজার গ্রাহকের চুলায় প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করে জাপানের জাইকা। প্রকল্পটির সুফলের পর কেজিডিসিএল নিজস্ব অর্থায়নে ২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের আওতায় নগরে ১ লাখ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯১ হাজার চুলায় প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। আর মাত্র ৯ হাজার চুলায় মিটার লাগানোর পর আরো অন্তত সাড়ে চার লাখ চুলা মিটারের বাইরে থাকবে। যেখানে গ্যাসে অপচয় এবং চুরি অব্যাহত থাকবে বলে মন্তব্য করে কেজিডিসিএলের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা নগরীর আবাসিকের সব চুলাকে মিটারের আওতায় নিয়ে আসতে চাই। এটা করতে পারলে আমাদের গ্যাসের ব্যবহার কমে যেত বা ব্যবহার হলেও রাজস্ব আসত। এখন চড়া দামে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে আমরা অপচয় এবং চুরির সুযোগ করে দিচ্ছি।

চট্টগ্রামে নতুন প্রকল্প নিয়ে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের মতো অবস্থা কেজিডিসিএলের নেই। নগরীর বাকি চুলাগুলোকে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা দরকার। এখন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি তৃতীয় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ঋণদাতার খোঁজ করছে বলে সূত্র জানিয়েছে। অন্তত আরো লাখখানেক চুলা, বিশেষ করে বস্তি বা কলোনিগুলোকে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা গেলে গ্যাসের অপচয় এবং চুরি ঠেকিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো যেত।

উল্লেখ্য, বর্তমানে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহের একমাত্র উৎস এলএনজি। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চড়া দামে এলএনজি আমদানি করে সরকার ভর্তুকি দিয়ে আবাসিক খাতে সরবরাহ দেয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইরন ডোম ভেদ করে তেল আবিবের সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলা
পরবর্তী নিবন্ধপাহাড়ে দুর্লভ ফল বন নারাঙ্গা