‘চট্টগ্রাম’ বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী জনপদ। নামের সাথেই লেগে আছে গ্রাম। সেই গ্রামের পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর প্রকৃতির অপার মায়ায় মানুষগুলোর ভেতরটাও যেন গড়ে ওঠে কোমল হয়ে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় এই নরম মনের মানুষগুলোও যে পাহাড়ের মতো দৃঢ়তা নিয়ে শত্রু মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হতে পারে, মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় পুরে জীবন নিয়ে আগুন খেলা খেলার সাহস সঞ্চয় করতে পারে, তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। এই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী, পুরুষ নির্বিশেষে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল, হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে ব্রিটিশদের শোষণ থেকে আমাদের মুক্তির বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীর নারীদের মধ্যে চট্টগ্রামের সন্তান বীরকন্যা প্রীতিলতা’র কথা কম বেশি সবাই জানে। জানে প্রীতিলতার কাছের বন্ধু আরেক অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত (যোশী)’র কথাও। কিন্তু এর বাইরে আরও অনেক অগ্নিকন্যা ছিলেন সেই অগ্নিযুগে যাদের অনেকের নামই আমরা সেরকম বিস্তারিত জানি না। জানিনা আমাদের মুক্তির আন্দোলনে তাদের সাহসিকতার গল্প। আমাদের সাহসী নারীদের সাহসী গল্পগুলো সব লিপিবদ্ধ হয়নি বলে তারা অনেকেই রয়ে গেছেন ইতিহাসের অন্তরালে। সেকারণে অনেক অতৃপ্তি আমাদের। সেই অতৃপ্তি কিছুটা হলেও দূর করার জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক আনোয়ারা আলম আমাদের উপহার দিয়েছেন ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী’ নামক তথ্যবহুল ইতিহাসের অসাধারণ এক দলিল।
প্রাচীন বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ, ইলিয়াস শাহের শাসনামল পেরিয়ে ১৪৯২ সালে হাবশী বংশের পতন ঘটিয়ে সুলতান হোসেন শাহ এর গৌড় রাজ্যে অধিকার পরবর্তীকালে সুবর্ণ যুগের সূচনা হয় বাংলার ইতিহাসে। চট্টগ্রামের আধিপত্য নিয়ে হোসেন শাহ এর সাথে বেশ সংঘর্ষ হয় ত্রিপুরার রাজা ধন্যমাণিক্যের। ১৫৩৮ থেকে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রামে আফগান শাসন চলে এবং ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের অধিকারে থাকে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে (১৬৫৮ – ১৭০৭) ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মোগল সম্রাটের শাসনাধীনে আসে। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের ফলশ্রুতিতে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ২৭ সেপ্টেম্বর ও ১৫ অক্টোবর তারিখে পূর্ববর্তী সন্ধির শর্তানুসারে নবাব মীর কাশিম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চট্টগ্রাম জেলা সমর্পণ করেন।
ইংরেজ সরকারের কাছে চট্টগ্রাম ছিল প্রাচ্যের রানী। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলার নারী সমাজকে রাজনীতিমুখী করে তোলে। এ সময় সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে স্বদেশী আন্দোলন। বাংলায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবের সূচনা হয় ১৯২০ সালের দিকে। ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে চট্টগ্রামের মানুষের গণ জোয়ার দেখে মহাত্মা গান্ধী চট্রগ্রামকে ‘তরুণ ভারত’ সাপ্তাহিকে বলেছিলেন, চট্টগ্রাম সবার আগে- ‘ঈযরঃঃধমড়হম ঃড় ঃযব ভড়ৎব.’
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাস্টারদা সূর্যসেন তাদের বিপ্লবী দলে নারী সদস্য নেননি। পরবর্তীতে মেয়েদের সীমাহীন আগ্রহে তাদের দলে নিলেও তাদের কাজ থাকে গোপনে অস্ত্রশস্ত্র রাখা, নিষিদ্ধ বই পড়া, অর্থ- অলংকার দিয়ে সাহায্য করা এসব। কিন্তু চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে নারীদের বিপ্লবী সংগঠনের সরাসরি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। মাস্টারদা ঘোষণা করলেন – ‘বাংলার বীর যুবকের আজ অভাব নেই। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে…. ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছিয়ে নেই।’
ব্রিটিশদের দিন ফুরাতে যে অগ্নিকন্যারা মশাল হাতে সম্মুখভাগে থেকেছেন তাদের প্রতি আমাদের আজন্ম ঋণ রয়ে গেলো। আমার ভাবতে অবাক লাগে সে সময়ে এমন গুমোট পরিবেশে বেড়ে ওঠার পরও কেমন করে এই নারীরা নিজেদের মধ্যে এত সাহসের সঞ্চার করেছেন! তাদের কর্মযজ্ঞে সময়ের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন তারা।
নেলী সেনগুপ্তা (১৮৮৬-১৯৭৩)
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার নারীরা যা করেছে তা তো তাদের করতেই হতো নিজের দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। কিন্তু ইংরেজ নারী নেলী সেনগুপ্তা যা করলেন তার জন্য এই মহীয়সী নারীর প্রতি ঋণী হয়ে গেলাম আমরা চট্রগ্রামের মানুষেরা তো বটেই, পুরো বাংলার মানুষেরা। নেলী সেনগুপ্তার জন্ম ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ শহরে। নেলীর বাবার নাম ফ্রেডরিক উইলিয়াম গ্রে এবং মায়ের নাম এডিট হেনরিয়েটা গ্রে। চট্টগ্রামের সন্তান ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তকে ভালোবেসে বিয়ে করে ইংরেজ মুল্লুক ছেড়ে এই বাংলায় স্থায়ী হয়েছেন নেলী সেনগুপ্তা। স্বামী যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত আইনজীবী হিসেবে খুব অল্প সময়েই খ্যাতিমান হয়ে যান। স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন এই ইংরেজ দুহিতা। ১৯২৭ সালের ১৭ নভেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সাইমন কমিশন নামে এক শ্বেতাঙ্গ কমিশন নিযুক্ত করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই কমিশন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিলে নেলী সেনগুপ্তাও স্বামী যতীন্দ্র মোহন এর সাথে মিছিলে স্লোগান দেন, গো -ব্যাক সাইমন। যতীন্দ্র মোহন এর মৃত্যুর পরও এই বিপ্লবী নারী স্বামীর পৈত্রিক ভূমিতেই ছিলেন আমৃত্যু।
এই বিপ্লবী নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। চট্টগ্রামে নেলী সেনগুপ্তার নামে কোনো স্মৃতিচিহ্ন আছে কি না জানি না। তবে থাকা জরুরি। এমন বীরদের সম্মান জানানোর মধ্যেও সম্মানের সম্মোহন থাকে।
লেখক আনোয়ারা আলম-এর প্রতিও শ্রদ্ধা এই বীর যোদ্ধাকে অনেক বিস্তৃতভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য।
সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা বীর কন্যাদের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, ইন্দুমতী সিংহ, সাবিত্রী দেবী, প্রেমলতা দে, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, কল্যানী দাস, বীণা দাশ, প্রমীলা দাস, অনিমা বিশ্বাস, নির্মলা চক্রবর্তী, অমিতা সেন, আশালতা সরকার, কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা, চন্দ্রবাসী দেবী, আরতি দত্ত(দাশ), নিবেদিতা চৌধুরী (নাগ), রীণা সেনগুপ্ত, রাজলক্ষ্মী দেবীসহ যাদের নাম আমরা জানি এবং যাদের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি তাদের প্রত্যেকের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।