শীত বিদায় নিয়েছে। আসছে বর্ষা মৌসুম। আসন্ন বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে শঙ্খ তীরবর্তী শত শত নৌকার মাঝি, জেলে ও কৃষকরা এখন পুরোদমে তাদের পুরোনো নৌকা মেরামতে নেমে পড়েছেন। অনেকে আবার তৈরি করে নিচ্ছেন নতুন নৌকা।
জানা যায়, শুষ্ক মৌসুমের এসময় বাংলাদেশের প্রায় নদী ও খাল শুকিয়ে যায়। অনেক নদী ও খালে নৌকা চলাচলের মতো পর্যাপ্ত পানিও থাকে না। তেমনি দেশের অন্যতম প্রধান নদী শঙ্খনদীতে পানি কমে অনেক স্থানে এখন জেগে উঠেছে চর। তাই এসময় নদীতে নৌকা চলাচল মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। বিপরীতে বর্ষা মৌসুমে এই শঙ্খনদী আগ্রাসী রূপ ধারণ করে। তখন শঙ্খ উপকূলবর্তী নৌকার মাঝি, জেলে ও কৃষকদের প্রধান ভরসা হয়ে উঠে নৌকা।
শঙ্খতীরবর্তী চন্দনাইশের ধোপাছড়ি, দোহাজারী পৌরসভা, লালুটিয়া, বরমা, বৈলতলী, জাফরাবাদ, সাতবাড়িয়া, সাতকানিয়ার বৈতরণী, পুরানগড়, বাজালিয়া, ধর্মপুর, আলমগীর, মাইঙ্গ্যাপাড়া, কালিয়াইশ, পূর্ব কাটগড়, মৈশামুড়া, মরফলা, নলুয়া, ঢেমশা, খাগরিয়া, আমিলাইশ এলাকাসমূহে এখন পুরাতন নৌকা মেরামত ও নতুন নৌকা তৈরীর ধুম পড়েছে। সবাই শুস্ক মৌসুমের এ সময় আগেভাগে নিজেদের নৌকা মেরামত অথবা নতুন নৌকা তৈরি করে বর্ষার জন্য প্রস্তুত রাখছেন।
শঙ্খতীরবর্তী নৌকার মাঝি, জেলে ও কৃষকদের সাথে আলাপ করে আরো জানা যায়, প্রতিবছরই পুরাতন নৌকা মেরামত করতে হয়। অন্যথায় বর্ষা মৌসুমে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। শুষ্ক মৌসুমের মেরামতকৃত নৌকা দিয়ে পুরো বর্ষা মৌসুম সবজি ও মালামাল পরিবহন করতে হয়। এছাড়া স্থানীয় লোকজন নৌকা নিয়ে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসা বিপুল পরিমাণ মূল্যবান গাছ, বাঁশ ও লাকড়ি আহরণেও মেতে উঠেন। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমে নৌকা প্রস্তুত থাকলে মাসিক ভিত্তিতে অনেকেই নৌকা ভাড়ায় নিয়ে যায়। নৌকা বড় ছোট হিসেবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। শঙ্খনদীর ধোপাছড়ি ঘাটের ইজারাদার মো. জাহাঙ্গীর আলম বাবুল জানান, প্রতি শীত মৌসুমে শঙ্খনদীর পানি শুকিয়ে যায়। এসময় পুরোনো নৌকাগুলো মেরামত করে নিতে হয়। চলতি মৌসুমে তিনি ইতিমধ্যে ১টি বড় নৌকা মেরামত সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া ছোট-বড় আরো ২টি নৌকা মেরামত করে বর্ষার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। তিনি বলেন, ছোট অর্থাৎ ৬০ মন ধারণ ক্ষমতার নৌকা মেরামতে বর্তমান সময়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। সমপরিমাণ নৌকা নতুন তৈরি করতে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রয়োজন হয়। এছাড়া বড় অর্থাৎ ২শ মনের অধিক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন নৌকা তৈরিতে লক্ষাধিক টাকা এবং মেরামতে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকার পর্যন্ত প্রয়োজন হয়। এসময় নৌকা কারিগরদের দামও অনেক বেড়ে যায়। ‘হাত’ হিসেবে নৌকা মেরামতের মঞ্জুরি নির্ধারণ হয়। প্রতি ‘হাত’ নৌকা মেরামতে ১০০ টাকা প্রদান করতে হয়। এভাবে প্রতিটি বড় নৌকা মেরামতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা কারিগরদের মঞ্জুরি দিতে হয়। এমনকি চলতি মৌসুমে নৌকা মেরামত করে যাওয়ার সময় কারিগরদের আগামী মৌসুমের জন্য অগ্রিম টাকাও প্রদান করতে হয়। অন্যথায় টিক সময়ে কারিগর পাওয়া কষ্ট হয়ে পড়ে।
নৌকা কারিগর সাতকানিয়ার কাটগড় গ্রামের মনোরঞ্জন দাশ জানান, নৌকা তৈরি ও মেরামত তার পূর্ব পুরুষের পেশা। তিনি বিগত ৪০ বছর ধরে এ পেশা ধরে রেখেছেন। প্রতি মৌসুমে তিনি ছোট বড় প্রকারভেদে ১০টি নৌকা মেরামত করতে পারেন। অর্ডার থাকলে ২/৩টি নতুন নৌকাও তৈরি করতে পারেন। এখন চলছে নৌকা মেরামতের শেষ সময়। ছোট নৌকা তৈরিতে ১০ থেকে ১৫ দিন এবং বড় নৌকা তৈরিতে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগে। নতুন নৌকা তৈরিতে বিশেষ করে সুরুচ, পিত্তরস, ছামালিশ গাছ বেশি ব্যবহার হয়। এসব গাছের নৌকা দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাছাড়া মেহগনি গাছ দিয়েও নৌকা তৈরি হয়। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়না। তিনি ছোট নৌকা তৈরিতে ১০ থেকে ১২ হাজার এবং বড় নৌকা তৈরিতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্তু মঞ্জুরি পান বলেও জানালেন। আবার পুরোনো নৌকা মেরামতে নৌকার সাইজ অনুযায়ী ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মঞ্জুরি পান বলে জানান।