সম্প্রীতি সুরক্ষায় সরকার ও সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১২ অক্টোবর, ২০২৪ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

আবহমান বাংলার স্বরূপ পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, বিভিন্ন ধর্মবর্ণগোত্রঅঞ্চল নির্বিশেষে বাঙালি জাতি এক ও অভিন্ন সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ ঐতিহ্যিক শ্বাশত নান্দনিক ধারণায় সমুজ্জ্বল জাতির সম্প্রীতির ইতিহাস দীর্ঘ প্রাচীন। সকল ধরনের চক্রান্তষড়যন্ত্র ও গুজব সন্ত্রাসকে সংহার করে প্রত্যেকেই যার যার ধর্ম মতে প্রতিটি আচারঅনুষ্ঠানউৎসব সাবলীল ধারায় উপভোগ করে আসছে। সাম্প্রতিক ছাত্রজনতার যুগান্তকারী সফল ও সার্থক গণঅভ্যুত্থানের অনুপম ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দৃঢ়তার সাথে তিনি ব্যক্ত করেছেন ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যবিহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। কোন বিভাজিত দেশ নয়, বরং সমতার ভিত্তিতে সকল নাগরিকের অধিকারনিরাপত্তা ও সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে স্বল্প সময়ের জন্য আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কিছুটা অসংগতি বিরাজিত থাকলেও বর্তমানে বহুলাংশেই তা নিয়ন্ত্রিত।

চলতি মাসের ৯ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আনন্দ উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। বিগত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উদ্বেগউৎকন্ঠা পরিলক্ষিত। কতিপয় দুর্বৃত্তদের নষ্টামির কারণে তারা ও তাদের মন্দিরসমূহ যৎসামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উল্লেখ্য প্রেক্ষাপটে শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে নিরাপত্তার শঙ্কা প্রকাশ পেলেও সরকারের চলমান যৌথ অভিযানে সকল বিশৃঙ্খলা দমন করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে পূর্ণাঙ্গ নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপন করার আহ্বান সর্বত্রই সমাদৃত। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও আশঙ্কিত যেকোন ধরনের সন্ত্রাসকে প্রতিহত করার প্রতিশ্রুতি উচ্চারিত। পবিত্র ইসলামের অমিয় নির্দেশনা পর্যাপ্ত ধারণ করেই মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ তাদের পাশে থেকে পূজা উৎসব সর্বাঙ্গীন সফল করার আশ্বাস দিয়েছেন। ভয় ভীতি প্রদর্শন বা দমননিপীড়নের বেড়াজাল থেকে শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামগ্রিক উৎসবমুখর রাখতে সরকারের সাথে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ। চিরায়ত সৌহার্দসম্প্রীতির বন্ধনে বাংলাদেশের মুসলিমহিন্দুবৌদ্ধখ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের অভূতপূর্ব সম্পর্কে ফাটল ধরানোর যেকোন উস্কানি প্রত্যাখ্যাত।

এটি সর্বজনবিদিত যে, পবিত্র ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম। এর প্রতিটি শিক্ষায় রয়েছে সৌহার্দসম্প্রীতিশান্তির অপূর্ব সম্মিলন। ইসলাম ধর্মের অন্যতম মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব হলো ধরিত্রীর প্রতিটি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান। এই স্বাধীনতা কেবল ধর্মবিশ্বাস লালানপালন করার স্বাধীনতা নয়। বরং ধর্ম না করার বা ধর্ম বর্জনের স্বাধীনতাও এর অন্তর্ভুক্ত। ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারো ওপর আক্রমণগালমন্দ করা, ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়াসহিংসতা পবিত্র ইসলামে বর্জনীয়। শুধু তাই নয়; অমুসলিমদের উপাসনালয়েও হামলা চালানোকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ কুরআনে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যাদের উপাস্যরূপে ডাকে তোমরা তাদের গালমন্দ করো না। নতুবা তারা শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাকেই গালমন্দ করবে’ (সুরা আন আম, আয়াত:১০৮)। পক্ষান্তরে একজন প্রকৃত মুসলমান দ্বারা অন্য কেউ কষ্ট পাবে এটিও গ্রহণযোগ্য নয়। একজন মুসলমানের চারিত্রক বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা🙂 বলেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ, সেই প্রকৃত মুসলিম’ (বুখারি)। এছাড়া ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জানমালের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও মুসলিমদের দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা🙂 বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনও ভিন্নধর্মী নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না যেটি ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি শরিফ, হাসিদ: ২৯৯৫)

বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব বা ঈদপূজাপার্বণআচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি বাঙালি সংস্কৃতিকৃষ্টির অনন্য বৈশিষ্ট্যরূপে এখনও অতিশয় দৃশ্যমান। চলমান শারদীয় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে অনিন্দ্য সুন্দর আনন্দধারায় সমগ্র জাতি উদ্ভাসিত। কালপরিক্রমায় ঋতু পরিবর্তনের সাথে প্রতি বছরের ন্যায় শরৎকালের সাদা মেঘ ও প্রকৃতির কাশফুল অকাতরে এ বছরও শারদীয় দুর্গাপূজার সার্বিক আয়োজনকে অবগাহন করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসবে শুভ মহালয়ার দিনক্ষণ থেকে চন্ডীপাঠের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। ঢাকের তালে তালে বাজনা বাজিয়ে পূজাঅর্চণায় দেবীর আরাধনা সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে পূজামন্ডপ কেন্দ্রিক পুরো এলাকাজুড়ে। সনাতন ধর্মের পঞ্জিকা মতে জগতের সামগ্রিক মঙ্গল কামনায় এবার দোলা বা পালকিতে চড়ে দেবী দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমন এবং ঘোড়া বা ঘোটকের পিঠে আসীন হয়ে স্বর্গালোকে বিদায়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে আগমনগমন দুইয়ের ফলই মন্দের ইঙ্গিত বাহক। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রমতে, এ বছর সারা দেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি মন্ডপে দুর্গপূজার আয়োজন করা হয়েছে। এ বছর ঢাকায় পূজোমন্ডপের সংখ্যা ২৫৩টি।

উল্লেখ্য যে, বাঙালি হিন্দু সমাজের এই পূজা শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, ধর্মবর্ণজাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের জন্য এই উৎসব একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অন্ধকারের শক্তিকে নিধন, অন্যায়অবিচারের অপ ও বর্বর শক্তিকে নস্যাৎ করে আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এই ধরনের ধর্মীয় উৎসব। ধর্মীয় উৎসবগুলো সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্বের নিগূঢ় বন্ধনকে অনন্য উচ্চতায় এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। পরমতসহিষ্ণুতা প্রদর্শনের অভিনব পন্থা অবলম্বনে অন্য ধর্মে বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও ধর্মের রীতিনীতি, আচারঅনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রতি পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান প্রদান ও এই ধারণাকে মর্যাদাসীন করার লক্ষ্যে মানবিকতায় উজ্জীবিত চেতনার নামই অসাম্প্রদায়িকতা। বাংলা ভুখন্ডে প্রত্যেক ধর্মের বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর এই ধরনের ঈদরোযামহরমপূজাপার্বণবড়দিনবৌদ্ধপূর্ণিমার সমীকরণে স্বজাত্যবোধের পরিচিতি নিরন্তর নন্দিত এবং প্রশংসিত।

আমরা সম্যক অবগত আছি, ফকির লালন শাহ আমৃত্যু জাতিভেদ তথা সাম্প্রদায়িকতার প্রতি তীব্র ঘৃণা, অসন্তোষ ও বিদ্রোহ প্রকাশ করে হিন্দু মুসলমানের পারস্পরিক সহমর্মিতা ও বন্ধুত্বের প্রেক্ষাপট রচনায় বহুভাবে তার উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছেন। তার যন্ত্রণাকাতর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দুমুসলমানবৌদ্ধখৃষ্টান/জাতিগোত্র নাহি রবে। শোনায়ে লোভের বুলি/নেবেনা কাঁধের ঝুলি, ইতরআতরাফ বলি/দূরে ঠেলেনা দেবে। আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই/সবার পাওনা খাবে সবাই, আশরাফ বলিয়া রেহাই ভবে/কেউ নাহি পাবে, ধর্মকূলগোত্রজাতি/তুলবে না গো কেহ জিগির, কেঁদে বলে লালন ফকির/কে মোরে দেখায়ে দেবে।’ বস্তুতঃ গাঙ্গীয় এ বদ্বীপ এলাকায় বাঙালিরা বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে আর্যদের আগমনের প্রায় পনর’শ বছর আগে। দ্রাবিড় সভ্যতার অন্তর্ভূক্ত এই জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের উৎসে ছিল কৃষি ভিত্তিক সংস্কৃতি। আর্যদের দখলে আসার পর রাজনীতি, ভাষাসংস্কৃতি ইত্যাদির বিষয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত শতাব্দীর পর শতাব্দী অব্যাহত থাকলেও শ্রী দুর্গাচন্দ্র সান্যালের ভাষায় “বৈদিক যুগ থেকে আর্যরা অনার্য সভ্যতা গ্রহণ শুরু করে।”

ঐতিহাসিক বহু তথ্য থেকে এটি প্রমাণিত যে, বাংলাদেশে আর্য হিন্দুদের শত বিরেধিতা সত্ত্বেও প্রচলিত অনার্যদের প্রচীন আমলের কৃষি ভিত্তিক সংস্কৃতি বধূবরণ, অন্ন প্রাশন, সংক্রান্তি, গৃহ প্রবেশ, জমি কর্ষণ, ফসল তোলা, আচারঅনুষ্ঠান, ব্রত ও প্রথার বিলুপ্তি ঘটেনি বরং বৌদ্ধ, হিন্দু এবং সূফী মনীষীদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারের পরও এ ধরনের কৃষি ও সংস্কৃতির উপাদানগুলো বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান আচারঅনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অস্তিত্বকে অত্যুজ্জ্বল করেছে। ভাববস্তুবাদী দর্শনের আপেক্ষিক সম্মিলনে প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম ইহ ও পারলৌকিক বিশ্বাস এবং কর্মের ভিত্তিকে শক্তিমান করেছে। মূলত: মানবিক মূল্যবোধের অনুরুদ্ধ বিকাশমানতা ও জনকল্যাণে নিবেদিত কর্মযজ্ঞের অনভিভূত ধারণায় ধর্ম যুগে যুগে নানা কাঠামোয় পল্লবিত হয়েছে।

জাতিবর্ণমানুষঅঞ্চলভেদে প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিপালিত ঐতিহ্যকৃষ্টিসংস্কৃতির বর্ণীল অবগাহনে ধর্মের চিরায়তরূপ জ্ঞাপিত। জীবনধর্মী কর্মপ্রবাহে ন্যায়অন্যায়, শুভঅশুভ, পাপপুণ্য, সত্যমিথ্যার দোলাচলে অদৃশ্যঅজানা অনুভূতির মানদন্ডে পারলৌকিক ইতিবাচক ফলাফল প্রত্যাশায় ধর্মভিত্তিক আচারআচরণ কখনো সমাজকে করেছে উজ্জীবিত; কখনো অতিশয় নিষ্প্রভ। শারদীয় দুর্গাপূজা প্রতিবছরই নতুন বার্তা বহন করে। দেশবিশ্বময় শান্তিনিরাপত্তা বিধানকল্পে সকল ধরনের সন্ত্রাসঅরাজকতানৈরাজ্য নিধন করে অসুর বধের মত সকল অপশক্তিকে রুখে দেওয়ার সংকল্প জোরালোভাবেই উচ্চকিত। প্রত্যেক নাগরিকের স্ব স্ব দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের মাধ্যমে অনাচারকদাচারমুক্ত হবে নতুন বাংলাদেশ। এই আশাবাদ ব্যক্ত করে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের সকল নাগরিকের প্রতি শারদীয় শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্গাপূজা : যুগে যুগে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আবাহন
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় তাফসিরুল কোরআন মাহফিল