চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেছেন এমন এক সময়ে যখন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমি যখন বক্তব্য রাখছি, তখন এটি হচ্ছে বিজয়ের মাস। আমাকে একজন মুজিব আদর্শের মহৎ মানুষের উপর বক্তৃতা দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আমি এ জন্য শুরুতেই চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কার্যকরী পরিষদের সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। একই সাথে চট্টগ্রামের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক যারা এখানে উপস্থিত আছেন তাদেরকেও আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমি এই মুহূর্তে যে বিষয়টি উপস্থাপন করতে চাই সেটি হচ্ছে একজন প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ যিনি আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, সংবিধান প্রণেতা ছিলেন এবং সর্বোপরি তিনি সার্বজনীনভাবে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। যিনি শ্রেষ্ঠ বেসামরিক পুরস্কারটি পেয়েছেন। বলা যায়, মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও সামপ্রদায়িকতাবিরোধেী আন্দোলনে তিনি পালন করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তাঁকে বলা হয় বিবেকের কণ্ঠস্বর। চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার অঙ্গনে শুধু নয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, নাগরিক পরিমণ্ডলেও তিনি ছিলেন বড় মাপের মানুষ। বাঙালির জাতীয় মানস গঠনে, সাংস্কৃতিক চেতনার উদ্বোধনে ও সম্প্রীতিবন্ধনে তরুণ ও নারী সমাজসহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করেছেন তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মতৎপরতা, আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা, মুক্তিযোদ্ধোদের প্রশিক্ষণে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা অপরিসীম।
ব্যক্তি জীবনে তিনি প্রথমে নাজিরহাট কলেজে পড়িয়েছেন। তিনি কখনও শিক্ষকতা করেছেন, কোথাও ব্যবসা করতে চেয়েছেন, কখনও কোহিনূর প্রেসের সাথে যুক্ত থেকেছেন। মূলত তিনি হয়ে উঠেছেন একজন ‘স্যার’। আমাদের জ্ঞানতাপস জাতিস্মর প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থের আমার শিক্ষক, জাতির শিক্ষক, শেখ হাসিনারও শিক্ষক তিনি রাজ্জাক স্যারকে বলেছেন ‘স্যার’। আমাদের প্রফেসর খালেদও হয়ে উঠেছেন সকলের ‘স্যার’। তিনি শ্রেণিকক্ষের স্যার হয়ে ওঠেননি, তিনি হয়ে উঠেছেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান-পর্বের একজন শিক্ষক হিসেবে। ড. আনিসুজ্জামান তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন, ‘তিনি সর্বশ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁকে দেখেছি সংকটে অবিচল থাকতে। মানুষের দুঃখে কাতর হয়েছেন, কিন্তু মনোবল হারাননি। তিনি দেশে আদর্শের একটি মডেল। দেশসেবা, সমাজসেবা, সাংবাদিকতা সব ক্ষেত্রেই তিনি একজন অনুকরণীয় মানুষ।’
মুক্তিযুদ্ধের কথায় আসি, আমি মনে করি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একদিনে সংগঠিত হয়নি। এই জন্য আমাদেরকে ইতিহাসের পেছনে যেতে হবে। ভাবতে হবে আমাদের শত বছরের ইতিহাস কি বলে। আমাদের ইতিহাস হচ্ছে, বাঙালি জাতিসত্তা নিজেই বিকশিত হতে চেয়েছিল। বাঙালি নিজস্ব সংগ্রামের মধ্যদিয়ে এগুতে চেয়েছিল। এটার জন্য বঙ্গভঙ্গের আগে ও পরবর্তী পর্যায় থেকে এমনকি এর পূর্বে গেলেও এই চট্টলভূমিতে দাঁড়িয়ে মাস্টারদা সূর্যসেন, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শেখ-এ-চাঁটগাম কাজেম আলী মাস্টার, হাবিলদার রজব আলীসহ অনেকের কথা বলতে হয়। এই নিরন্তর মুক্তিসংগ্রামে আমাদের আরেকটা বিশেষ ভূমিকা আলোচনা করতে হয়। সেটি হচ্ছে, বাঙালি মুসলমানের বিকাশ। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, আহমদ ছফা, সলিমুল্লাহ খান এই বিকাশের মধ্য দিয়ে কিংবা এর আগে শিখাগোষ্ঠী বিকাশের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার, বাঙালি বিবেকের মুক্তির একটি বিরাট দিক দেখতে পাই।
তাহলে আমরা এখানে কি দেখি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ছেচল্লিশ-এর পরে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী একটি সীমান্ত পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি সুচরিত চৌধুরীর সাথে যৌথভাবে এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। আমাদেরকে এই বিষয়টি বিবেচনা আনতে হবে। আপনারা জানেন সেই সময়কালে সীমান্ত পত্রিকার প্রশংসা করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মূল্যবান অভিমত ব্যক্ত লিখেছিলেন। সীমান্ত পত্রিকা শুধু সীমান্ত পত্রিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সীমান্ত পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়ে তখন তারা প্রান্তিক নাট্য সংঘ গড়ে তুলেছিল। হরিখোলার মাঠে তাদের সমাবেশ হয়েছিল। আমি অনিবার্যভাবে স্মরণ করছি আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদকে তিনি শুধু একজন পুঁথি সংগ্রাহক ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের আরেকজন জাতিস্মর ব্যক্তিত্ব। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশে পুঁথি সংগ্রহ শুধু নয়, তাঁর হরিখোলার মাঠের অভিভাষণগুলো, তাঁর কুুমিল্লার অভিভাষণগুলো আমাদেরকে স্মরণে রাখতে হবে। তাঁর বিষয়ে ড. সলিমুল্লাহ খান বলেছেন ‘চট্টগ্রামের একজন এপিক কারেক্টর হচ্ছে মুন্সি আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ।’ তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গ একটি অবিভাজ্য, বাংলাভাষাকে কোনোমতে অবহেলা করা যাবে না।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি প্রবীণ মানুষ, আমি তরুণদের কাছে এসেছি। আপনাদের প্রজ্ঞার কাছে এসেছি। আপনাদের শুনতে এসেছি।’ আমি বিশেষ করে ছেচল্লিশের পূর্বের কথা বলছি। যেটা নিরন্তর মুক্তি সংগ্রামের মধ্যে যাচ্ছে, সাংবাদিকতা-সংস্কৃতি-সাহিত্যের বিকাশের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আসলে আজকে আমার যে স্মারক বক্তৃতা, তাও আমাদের তরুণদের উদ্দেশ্যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে এটি ধারণ করতে পারে।
এবার আসুন ১৯৪৭ এর পরে আমরা ১৯৪৮ সালে যখন স্বাধীনতা পেলাম, আমাদের প্রথম বিভ্রান্তিকর অর্জনটি ছিল আমরা আপাত মুক্তির একটি স্বাদ পেয়েছিলাম। কিন্তু এটি অল্প সময়ের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বে, ভাষার দূরত্বে, খাদ্যের দূরত্বে, সংস্কৃতির দূরত্বে এটি কখনও সম্ভব ছিল না। যার ফলে ৪৮-এ জিন্নাহ যখন বললেন, ‘উর্দুই হবে আমাদের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ তখন বাঙালিরা গর্জে উঠেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেই ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমি যে পূর্বে ভাষা আন্দোলনের কথা বলেছি সেটা আজকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে রূপায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ কতটুকু বিস্তৃত, বাঙালি জাতিসত্তা আজ কতটুকু বিস্তৃত হতে পেরেছে, বাঙালি মুক্তিসংগ্রাম কতটা ব্যাপকতা পেয়েছে সেটি ৫২’র ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করে। আজকে আমার মনে হয় বাংলার শ্রেষ্ঠ মর্সিয়া সংগীত আলতাফ মাহমুদ রচনা করে গেছেন। এখানে একটা জিনিস লক্ষ্যণীয়, এই তত্ত্বযোগীরাই পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে কর্মযোগী হয়েছেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ এই মর্সিয়া সংগীত যখন গীত হয় বুঝতে হবে যে সমস্ত বাঙালি বাংলা ভাষার জন্য হাহাকার করছে। আলতাফ মাহমুদ এটি রচনা করে শহীদ হয়েছেন। নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমেদ একটা কথা বলেন, ‘মুনীর চৌধুরীর নাটক কবর আছে কিন্তু তার শারীরিক কবর নেই। এক রক্তাক্ত প্রান্তরে মুনীর চৌধুরী আরেক রক্তাক্ত প্রান্তরের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন।’
বোঝা যাচ্ছে ৫২ থেকে মানুষের মুক্তির যে মিছিল শুরু হয়েছিল তার ঢেউ ৫৪’র যুক্তফ্রন্টের আন্দোলন, ৫৮’র আয়ুববিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬তে চট্টগ্রাম থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা আন্দোলন থেকে ৬৯-এ দেখি আস্তে আস্তে এক গণঅভ্যুত্থান তৈরি হলো। এখানে স্মরণ করছি তাঁর গুরু মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হকের মতো কীর্তিমানদের মাঝে একজন সাধারণ শেখ মুজিব মিছিলের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ালেন। তাজউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘মিছিলের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ালেন মুজিব ভাই’। সাত কোটি মানুষের আবেগ, অনুভূতি একীভূত হয়েছে, ঘনীভূত হয়েছে তাঁর মধ্যমণি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আপনারা মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা গান শুনে থাকবেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের হে বিধাতা, তোমায় নমস্কার’। এতে অতিশয়োক্তি থাকলেও এখানে যে আবেগের কথা বলা হচ্ছে তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শেখ মুজিবুর রহমান।
আমি যেটা বলছিলাম, একাত্তরের যুদ্ধ নয় মাসের একটা মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয়, এ যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যে আমাদের অনেকগুলো সময় পেরিয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী স্বৈরশাসন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। কি মর্মান্তিক! গ্রীক নাটকের চাইতেও মর্মান্তিক ট্রাজেডি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তীয়-আত্মীয়সহ সপরিবারে হত্যা হয়। এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের এক ধরনের বিচার হয়ে গেলেও বাংলার মানুষ এতে তৃপ্ত নন। যিনি বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, সমগ্র জীবন কারাগারে কাটিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়েছেন তাঁকে অনুসরণ করে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখন লড়ছেন।
আর যে মুক্তির কথা বললাম, নিরন্তর জাতীয়তাবাদের উত্থানের কথা বললাম, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশের কথা বললাম প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ হলেন তারই একজন সৈনিক। বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগামী হিসেবে আমরা এতক্ষণ যা কিছু বললাম তা একজন বিবেকের কণ্ঠস্বরের কথা। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আব্দুল করিম বলেন, ‘তিনি দৃঢ়চেতা, যা বিশ্বাস করেন তা বলেন এবং লেখেন। বক্তব্যে তিনি যুক্তিবাদী।’৩ কবি অভীক ওসমান (খালেদ সাহেবের জীবদ্দশায় লিখিত প্রথম কবিতা) যথার্থই লিখেছেন তার কবিতায়- ‘তাঁকে দেখলেই মনে হয় বাংলার বিবেক হেঁটে যায়/ এই দুর্গত বাংলায়।’
একটা জিনিস বিস্ময়করভাবে লক্ষ্যণীয়, ইতিহাস আর ব্যক্তি কে যে কাকে গড়ে তোলে এটা ভাবনার বিষয়। বড় একজন ব্যক্তিত্বের উত্থানের পেছনে ইতিহাসের পটভূমি কার্যকর থাকে, জনমণ্ডলী গড়ে তোলে তার জননায়কদের। আবার কোনো কোনো ব্যক্তিত্ব তার সৃষ্টিশীল কর্মে জনতার আবেগকে ভাষা দেন, তাদের মধ্যে স্বপ্ন সঞ্চারিত করেন এবং ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে নয়া গন্তব্যের দিকে ঘুরিয়ে দেন এর বাঁকে। তাঁদের কারও প্রভাব পড়ে সরাসরি, কেউ বা উন্মীলিত হয়ে উঠেন ধীরে ধীরে। ইতিহাসের পাদপ্রদীপে তাঁরাই হয়ে উঠেন জনহিতৈষী। এই প্রেক্ষাপটেই মোহাম্মদ খালেদ হয়ে উঠেছেন কালের নায়ক। কোন কালের নায়ক? সেটি হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর ৪৭ পরবর্তী ৭১ পূর্ববর্তী এবং ৭১ পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি জাতিসত্তার মূল সংস্কৃতি বিকাশে অসামপ্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ একজন নায়ক। খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন বলেন, ‘তিনি কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ান না। যা সত্য প্রতিকূল পরিবেশেও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে কুণ্ঠিত হন না। মৌলবাদীদের সভায় গিয়েও মৌলবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে দ্বিধা করেন না।’ প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ যে সংগ্রাম ও সাধনায় সাংবাদিক হয়ে উঠেছিলেন এরকম অসংখ্য সাংবাদিক ছিলেন ঢাকায়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া যিনি বঙ্গবন্ধুকে পেট্রোনাইজ করেছিলেন। আমরা আমাদের বক্তব্য প্রফেসর খালেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো।
আমরা প্রথমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন আলোচনা করব। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করলেও আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসেবেও ছিলেন খ্যাতিমান। তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকার বিষয়ে লিখতে গিয়ে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান বলেছেন, ‘প্রফেসর খালেদের ঋজুমাত্রিক ও আদর্শনত জীবনে যে এক প্রতিবাদী রাজনীতির সংযোগ ঘটবে এটাই প্রত্যাশিত। তবে তাঁর জীবনে কোন সত্তাটি বড় এটাও এক দুরূহ প্রশ্ন; জীবনের গ্রন্থি থেকে তাঁর বিভিন্ন সত্তার ভাগগুলো জল-অচল কক্ষে বিভাজিত হয়নি। এগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে পৃথক নয়। ফলে তাঁর ব্যক্তিজীবন ও সাংবাদিকজীবনের যেমন পার্থক্য করা যায় না, তেমনি অন্যান্য জীবন থেকে রাজনৈতিক জীবনের দেয়ালটা কোথায় পৃথক তাও নির্দেশ করা প্রায় অসম্ভব। বস্তুত তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বরূপে নানা মাত্রিকতার সংযোগ সহজেই পরস্পরের সীমা ভেদ করে বহুদূর অতিক্রম করে অজান্তেই একটা সন্নিধিক রেখাঙ্ক নির্মাণ করে তুলেছে।’
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত শিশুসাহিত্যিক-সাংবাদিক রাশেদ রউফ-এর লেখা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জীবনী থেকে জানতে পারি, স্কুলজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিমনস্ক ছিলেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ অবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছর লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সেই বছরে মোহাম্মদ খালেদ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। তখন থেকে ভারতের মুসলিম ছাত্র-জনতা টেকনাফ থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত একটি স্লোগান নিয়ে সংগ্রামে নেমেছে। সেটি হলো- ‘ভারত বিভাগ চাই’। মোহাম্মদ খালেদ এ আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। পরবর্তীকালে তিনি যখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বিএ শ্রেণিতে পড়ার জন্য ভর্তি হন, তখন পরিচয় ঘটে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। এর পরে তৎকালীন অবিভক্ত ভারত ও অবিভক্ত বাংলার মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনকারী মহান নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়।
রাজনীতিতে আগমন নিয়ে অধ্যাপক খালেদ নিজেই বলেছেন, ‘রাজনীতি শুরু করি পাকিস্তান কনসেপ্টে বিশ্বাসী হয়ে। মুসলমানদের দাবি পাকিস্তান আর হিন্দু নেতাদের দাবি হিন্দুস্তান। …মুসলমান ও হিন্দুদের অনেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে অথ ভারতের পক্ষেও ছিলেন। তবে এদেশের ৯৮ ভাগ মুসলমানই পাকিস্তানের পক্ষে। কারণ ব্রিটিশদের অন্যায় অবিচার মুসলমান-হিন্দু সবাই দেখেছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না। মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, ইসলাম ধর্মের সাম্যের আলোকে এদেশের মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এসব কথায় বিশ্বাসী হয়ে আমরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছি। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে আমরা বেশ খুশি হয়েছিলাম কিন্তু আমাদের সে খুশি এবং শ্রম ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তানের শাসকচক্র বাঙালিদের সহ্য করতে পারল না। চক্রান্ত শুরু হলো বাঙালিদের বিরুদ্ধে। আমাদের বাঙালি নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে একে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বুঝে গেলেন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের নেতাদের সম্বন্ধে। মুসলিম লীগের প্রতি আমাদের আস্থা কমতে লাগল। ঐ তরুণ বয়সে বুঝে গেলাম পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাঙালিদের উপরে উঠতে দেবে না। তারা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক তথা বাঙালিদের প্রতি বৈরী ভাব নিয়ে এগোচ্ছে। ….মূলত পাকিস্তানি শাসকদের অনৈতিক আচরণের কারণে একজন বাঙালি মুসলমান হয়ে মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করি।’
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি যে আশা ও মোহ, অন্য অনেকের মতো মোহাম্মদ খালেদেরও অতি অল্প সময়ে তা দূর হয়ে যায়। মুসলিম লীগের অন্য নেতাকর্মীর মতো তারও মোহ ও স্বপ্নভঙ্গ হলো। ফলে এক অতৃপ্তবোধ ও মর্মবেদনা কাজ করে অন্তরে। এমন সময়ে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। সঙ্গে ছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মোহাম্মদ খালেদ যোগ দিলেন সেই দলে। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসহ প্রায় সকল আন্দোলনে অধ্যাপক খালেদ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।এক পর্যায়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধীরে ধীরে অনিবার্য পুরুষে পরিণত হন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এম আর সিদ্দিকী সাহেবের বাসায় বৈঠক করেছিলেন। সে সভায় উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক খালেদও।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ও অধ্যাপক খালেদের ভূমিকা সম্পর্কে শব্দসৈনিক, চট্টগ্রাম বেতারের সাবেক প্রধান আঞ্চলিক প্রকৌশলী মোঃ আমিনুর রহমান বলেন, ‘২৬ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ দুপুর ১টা পর্যন্ত বিভিন্ন সময় স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়েছিল। উক্ত সময়ে অধ্যাপক খালেদ সার্বক্ষণিক আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরামর্শ প্রদান করেন।’ পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ছিলেন প্রফেসর খালেদ। তিনি তরুণদের নিয়ে এগিয়ে গেছেন পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭৩ সালে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সংসদ নির্বাচিত হন। সত্তরের নির্বাচনে খর্বকায় সাধারণ মানুষটি দীর্ঘদেহী পাকিস্তানি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পরবর্তীতে স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে অসমপরিমাণ মল্লযুদ্ধে হারিয়েছেন। এটি ছিল তাঁর জন্য বিস্ময়কর জয় আর ফজলুল কাদের চৌধুরীর জন্য বিস্ময়কর পরাজয়। এক্ষেত্রে তিনি আরও মহীয়ান হয়ে উঠেছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে গভর্নর নিযুক্ত করেন।
এবার আমরা তাঁর সাংবাদিক জীবনকে একটু পর্যালোচনা করি। তিনি যখন সাংবাদিকতায় এসেছেন তখন সাংবাদিকতা বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। তার রক্তীয় তার গুরু ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক যখন তাঁকে সাংবাদিকতায় ডাকছেন তখন খুব সংকটময় সময়। কারণ ৫৮’র সামরিক শাসনে এসে কীভাবে কলাকৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে সে প্রসঙ্গে নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, সাংবাদিকতায় একটা ইন্টেলিজেনসিয়া বা একটা বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এবিএম মূসা, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আব্দুস সালাম অথবা অন্যান্যরা যখন সাংবাদিকতায় আসছেন ঠিক একই সময়ে প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদও সাংবাদিকতায় এসেছেন। সাংবাদিকতায় এসেই তিনি আজাদীর জন্য অনেকগুলো ভূমিকা রেখেছেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক পরিপূরক হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছেন। এ কারণেই তিনি রাজনীতি সচেতন ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক হতে পেরেছেন। তার চরিত্র ও জীবনযাপন সবকিছুর মধ্যে তিনি নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন।
(চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।