দুই বাংলার কয়েক প্রজন্মের কোটি পাঠকের প্রিয় ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার এখন লেখালেখির জগতের মায়া ছেড়ে অনেক দুরে। ধ্রুব সত্যের মতো এ যেন জীবননান্দের সেই বিখ্যাত উক্তি – ‘নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’। করেনা মহামারীর পরও সাহিত্য জগতের যে কয়জন কিংবদন্তী জীবিত ছিলেন সমরেশ মজুমদার ছিলেন তাঁর অন্যতম।
ভারতের দার্জিলিং জেলার উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার জন্য ২০০২ থেকে ২০০৭ সালে শিলিগুড়িতে কাটিয়েছি। সমরেশ মজুমদারের লেখার সুবাদে উত্তরবঙ্গের জায়গাগুলো ছিল আগে থেকেই সুপরিচিত। ফলে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা সবই আমার চেনা চেনা লাগতো। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরেই নকশালবাড়ি। প্রায়ই যেতাম, কখনো বেড়াতে, কখনো নেপাল সীমান্ত দেখতে। ভারত এবং নেপালের সীমান্তঘেঁষা নকশালবাড়ি এক সময় বিপ্লবী আন্দোলনের তীর্থস্থান ছিল। গত শতকের ষাট এবং সত্তর দশকের নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রভাব পড়েছিল উপমহাদেশের সমাজ জীবনে। সাহিত্যঅঙ্গনেও তার রেখা ছড়িয়েছিল। চারু মজুমদার, কানু সান্যালের আন্দোলনের প্রভাব পড়লো অনেক কালজয়ী উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা ও গানে । ইতিহাসের এক চিরচিহ্ন রেখে গেলো আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায় নকশাল আন্দোলন নিয়ে প্রচুর সাহিত্য রচিত হয়েছে। বুকার পুরস্কার জয়ী অরুন্ধতী রায়ের “গড অব স্মল থিংস্” উপন্যাসে একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। নকশাল আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন মহাশ্বেতা দেবী। তাঁর ‘হাজার চুরাশির মা’ নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা উপন্যাস। ১৯৯৮ সালে এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, নাম ছিল “হাজার চুরাশি কি মা”। সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কিন্নর রায়, শৈবাল মিত্র রচিত বেশ কিছু উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনের কথা রয়েছে। এই আন্দোলনের প্রভাবে ছোটগল্প, নাটক, গণসংগীত রচিত হয়েছিল যা বাংলার চিন্তাশীল মানুষকে প্রভাবিত করেছিল।
সমরেশ মজুমদারও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর লেখনীর ধারাকে আমরা শার্ল বোদলেয়ারের ভাষায় বলতে পারি, It is true that the great tradition is over and the new tradition is not found. নকশাল বাড়ির আন্দোলনও তাঁকে স্পর্শ করলো। এনিয়ে উপন্যাস ধারার লেখায় সমরেশ মজুমদারের আগমন এক নতুন সৃষ্টির দিগন্ত মেলে ধরলো। তবে তিনি এক নতুন ঐতিহ্যের শুরু করলেন। বিপ্লবের মন্ত্র ধ্বনিত হয়ে উঠলো তাঁর লেখা কালজয়ী কালবেলা উপন্যাসে। যে উপন্যাসে রাজনীতির সঙ্গে প্রেম মাধুর্যের সমান্তরাল প্রবাহ বিদ্যমান। ড. নিখিল চন্দ্র রায় নকশালবাড়ি আন্দোলন ও বাংলা উপন্যাসের গবেষণায় কালবেলার এক সুন্দর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নিখিল চন্দ্র রায়ের মতে, “উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অনিমেষ মিত্র। অনিমেষ মিত্রের রাজনীতির ধারা বিবরণ ক্রমাম্বয়ে বিবৃত হয়েছে। উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সিপিআইএম থেকে বিতাড়িত বা বেড়িয়ে আসা কর্মীদের দেশ মুক্তির ব্রত, চিনের পথ ধরেই ভারতবর্ষে মুক্তি কামনা, জমিদার জোতদার খতম, অস্ত্র সংগ্রহ, সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব, পুলিশি নির্যাতন প্রভৃতি। নকশাল আন্দোলনের ট্রাজিক কাহিনি উপস্থাপনে লেখক যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তা এক কথায় অনন্য সাধারণ।”
উপমহাদেশে সর্বাধিক পঠিত তাঁর কালবেলা উপন্যাসটি এখনো সমান জনপ্রিয়। কালবেলা লেখা প্রসঙ্গে সমরেশ মজুমদার বলেছেন, “তবু ‘উত্তরাধিকার’ এর পর ‘ কালবেলা’ লিখতে বসে আমাকে এই সময়টাকেই বাছতে হয়েছে। আমি যেভাবে দেখতে চেয়েছি তার সঙ্গে অনেকেরই মতে মিলবে না, মিলতে পারে না। ওই সময়টাকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে জানতাম এই দাবি করি না। কিন্তু আচ গায়ে না লাগুক মনে লেগেছিল। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার সময় আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে এসেছি, কেউ কাউকে স্বীকার করতে চায় না। অতএব, আমার বিশ্বাসটাই আমার কাছে সত্য।
কালবেলা রাজনৈতিক উপন্যাস কী না সে প্রসঙ্গেও সমরেশ মজুমদার বলেছেন – “কালবেলা’ কি রাজনৈতিক উপন্যাস? আমি জানি না। কারণ এ ধরনের সাইনবোর্ডে আমি বিশ্বাসী নই। আমরা এক দারুণ অবিশ্বাসের কালে বেঁচে আছি। কেউ যদি বিশ্বাস করে ভুল করেন তবে তিনি কিন্তু আমাদের থেকে প্রাণবন্ত। অনিমেষরা যদি ভুলটা বুঝতে পেরে সঠিক পথটাকে খুঁজে পায় তা হলে কিন্তু ভুলটা মূল্যবান হয়ে যাবে।” আবার তিনি বলছেন, “কিন্তু কালবেলা ভালবাসার উপন্যাস। দেশ, মানুষ এবং নিজেকে। কারণ নিজেকে যে ভালবাসতে পারে না সে কাউকে গ্রহণ করতে পারে না।” তিনি কালবেলায় সময়টাকে ধরতে চেয়েছেন। কোনও মানুষ কিংবা ঘটনার সরাসরি কিছু নয়।
সমরেশ মজুমদারের কালবেলা উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৯০ সনের পহেলা বৈশাখ। প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা। নকশালবাড়ি আন্দোলনকে উপজীব্য করে যে সমস্ত উপন্যাস এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে বহুপঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস কালবেলা। কালবেলা উপন্যাসে যদিও মাধবীলতা ও অনিমেষের প্রেমের মহিমাম্বিত রূপ দেখানো হয়েছিল। কিন্তু উপন্যাসে ষাট সত্তর দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। উপন্যাসে ষাট সত্তর দশকের উত্তাল রাজনীতির চিত্রের পাশাপাশি পুলিশি নির্যাতন, সন্ত্রাসের চিত্র লেখক তাঁর লেখনিতে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন।
একটা আন্দোলন বা সমাজ বিপ্লবের ইতিহাস তিনি প্রবাহিত করতে চাইছিলেন কালবেলার মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাস কিংবা রাজনীতি বিজ্ঞানের শব্দকোষকে তিনি উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে ষাট সত্তরের দশকের বিখ্যাত শ্লোগানকে অতি সন্তর্পনে কালবেলায় নিয়ে এসেছেন। এক সময় বিশ্ব কমিউনিজমের অন্যতম বিখ্যাত নেতা মাও সেতুং এর ‘Political power grow out of the barrel of gun’ বা বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস সহ আরো বিপ্লবীদের উক্তি উঠে এসেছে সমরেশ মজুমদারের কালবেলায়। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির দীক্ষা দিতে অনিমেষের পাঠরূপ হয় এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে। যেখানে সমরেশ মজুমদার উল্লেখ করেছেন -“প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার আমরা কী চাই। আমরা যারা এখানে রয়েছি তারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কাজ করেছি। মার্কসবাদের রীতিনীতি পদ্ধতিগুলোর সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা ঔপনিবেশিক সংসদীয় কাঠামোয় নিজেদের মানানসই করে নিয়ে কয়েকটা রাজ্য সরকার গঠন করতে পারলেই উর্ধ্ববাহু হয়ে নৃত্য করবেন। আমরা মনে করি এই পথে সাধারণ মানুষের মুক্তি কখনওই আসতে পারে না।” রাজনীতির এই পাঠ যার কাছে থেকে কালবেলার চরিত্র অনিমেষ শুনছেন সেই পরিবেশেরও একটা বিবরণ কালবেলাতে পাওয়া যাচ্ছে। অনিমেষের রাজনীতিতে যুক্ত হবার বিবরণটাও তদানীন্তন রাজনীতির বাস্তব প্রতিফলন। ড. নিখিল চন্দ্র রায় যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘কালবেলা যেন নকশাল আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক দলিল।’
২
গত শতকের নব্বই দশকের বাংলাদেশের প্রায় সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে সমরেশ মজুমদার ছিলেন অগ্রগণ্য। পশ্চিমবঙ্গের মতো এ দেশের পাঠকের কাছেও সমান জনপ্রিয়। তিনিও এর যথাযথ মূল্যায়ন করতেন। ২০১৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় সমরেশ মজুমদারের এক সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। ওই সাক্ষাৎকারের আলাপে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, “বাংলাদেশের পাঠকরা আমাকে খুব ভালোবাসে“। এর কারণ হিসেবে তিনি বললেন “এখানে এলে কোনো পার্থক্য মনে করি না। কারণ বাংলাদেশের পাঠকরা আমাকে খুব ভালোবাসে। এখানকার আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করে। মনে হয় নিজ শহর কলকাতাতেই আছি।”
বাংলাসাহিত্যের কিংবদন্তীতুল্য খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামেও এসেছেন। কথা বলেছেন পাঠকের সঙ্গে। দূতিয়ালির কাজটি করেছিল চট্টগ্রামের প্রকাশনী সংস্থা বাতিঘর। ‘আমার জীবন ও আমার রচনা’ শীর্ষক এক বিশেষ অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়েছিল। বাতিঘরের প্রেসক্লাব ভবন শাখায় অনুষ্ঠানটিতে সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে চট্টগ্রামে এটাই ছিল প্রথম আয়োজন।
যদিও এর আগে অনেকবার সমরেশ মজুমদার বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু সেবারই প্রথম চট্টগ্রামে এসেছিলেন। পাঠক অনুরাগীদের ভালোবাসা এবং সমাদর পেয়ে ঔপন্যাসিক মুগ্ধ হলেন। সেটা তাঁর বক্তব্যেও তুলে ধরলেন– ‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কেন জানি তাদের আবেগ দেখাতে পারে না। কিন্তু আপনারা পারেন। আপনারা দীর্ঘসময় আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। এই যে আমি এত এত পুরস্কার পেয়েছি, আপনাদের ভালবাসা সেসবকে ছাড়িয়ে গেছে।’
অনুরূপভাবে সমরেশ মজুমদার সিলেটে গল্প–আড্ডায় মুগ্ধ করেছেন পাঠক–সুধীজনকে। এই অনুষ্ঠানেরও আয়োজক ছিল বাতিঘর। ‘বই প্রকাশের গল্প’ নামে সমরেশ মজুমদারের আড্ডার আয়োজন করে বাতিঘর সিলেট শাখা। এসব আয়োজনে দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার জানিয়েছেন তার লেখক হয়ে ওঠার শুরুর কথা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার স্মৃতিকথা তারই মুখ থেকে শুনেছেন শ্রোতারা। সমরেশ মজুমদারকে কাছে পেয়ে অভিভূত হয়েছেন অনেকে। (দেশ রুপান্তর,১৪সেপ্টেম্বর ২০১৯)
লেখক হতে হলে ভেতর থেকে তাড়না থাকতে হয় এমন মন্তব্য করে বাংলা সাহিত্যের বরেণ্যে লেখক সমরেশ মজুমদার বলেছেন, ‘উপদেশ দিয়ে লেখক হওয়া যায় না। একজন মা যখন সন্তানের জন্ম দেন তখন সেই সন্তানকে যেমন যত্ন না করলে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় না ঠিক তেমনি একজন লেখকের ভেতরে একটা উপলব্ধি ও তাড়িত না করলে তিনি লেখক হতে পারেন না।’ ‘অপরিচিত জীবনযাপন’ নামে প্রকাশিত নতুন বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাবলীলভাবে তুলে ধরলেন নিজ অভিজ্ঞতা। অকপটে স্বীকার করলেন বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার গৌরবকে। তারমতে ঢাকা বাংলা সাহিত্যের এই জায়গা দখল করেছে হুমায়ুন আহমেদ এর কারণে। এই দায় স্বীকার সহজেই কেউ করতে চায় না।
৩.
নকশালবাড়ির আন্দোলন এখন ইতিহাস। কিন্তু মুছে যায়নি তার গভীর বেদনার ক্ষত। সমরেশ মজুমদারও তাই মনে করেন। তার কালবেলার দেখা সমাজকে চিত্রিত করলেন ভিন্নভাবে তবে ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে। এক্ষেত্রে সমরেশ মজুমদারের অভিমত “আসলে ‘উত্তরাধিকার‘, ‘কালবেলা‘ ও ‘কালপুরুষ‘ আমার লেখালেখি জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। এই উপন্যাসত্রয়ীর জনপ্রিয়তা ও পাঠকদের ভালোবাসা মাথায় রেখে ‘মৌষলকাল‘ লিখছি।“
কিন্তু সমরেশ মজুমদারের রাজনৈতিক উপন্যাসের গতি থেমে গেল গত ৮ মে ( ২০২৩) তারিখে। বেঁচে থাকলে তার হাত ধরে নির্মিত হতো আরও অনেক কালজয়ী ইতিহাসের ঘটনার নতুন নতুন উপন্যাস।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়