সমম্বয়বাদের মূল সুর – ইউসুফ মুহম্মদের দোঁহা

প্রগতি চেতনা বক্সী | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

কবিরা হলেন দ্বিতীয় প্রজাপতি। প্রজাপতির কাজ যেমন প্রকৃতি সৃষ্টি করা তেমনি কবির কাজও কবিতার মাধ্যমে শব্দের নতুন খেলায় ভাবের সৃজন করা। প্রকৃত কবির জাত, ধর্ম বা বর্ণ কিছুই হয় না। সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা, মানুষে মানুষে ঘৃণা ও হানাহানির ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর একটাই পরিচয় থাকে, তিনি হলেন একজন কবি। তাঁর ধর্ম কবির ধর্ম, তাঁর বর্ণ কবির বর্ণ তাঁর সাধনা হলো কবিতা ও শব্দের সাধনা। বাংলাদেশের কবি ইউসুফ মুহম্মদের লেখা দোঁহাগুলো সেই ইঙ্গিত বহন করে।

প্রকৃত পক্ষে দোঁহার রচয়িতা ছিলেন বেনারসের সন্ত কবীর এবং তাঁর সমসাময়িক সন্ত কবিরা। তারও অনেক পূর্বে বুদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা ধর্ম প্রচারের স্বার্থে দোঁহা রচনা করেন। তবে কবীর ছিলেন ব্যতিক্রমী দোঁহার জনক। তাঁর জন্ম ১৩৯৮ সালে এবং ১৫১৮ সালে ১২০ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন মর্মে বেশির ভাগ গবেষক একমত হয়েছেন। সে সময়ের ভক্তি আন্দোলন ও বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠির মধ্যে বিরোধ নিরসনে কবীরের দোঁহাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কবীরের দোঁহার মূল সুর ছিল সমম্বয়বাদ। তাঁর দোঁহা হিন্দুমুসলিম এবং শিখদেরকে সেই সময় গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

ইউসুফ মুহম্মদের দোঁহাকবিতাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনি আদতেই একুশ শতকের কবীর। তাঁর দোঁহাকবিতার প্রতিটি পরতে রয়েছে প্রেম, মানব প্রেম, প্রকৃতি, বাস্তবতা, স্বপ্নদেখা, স্বপ্নভঙ্গ ও অসাম্প্রদায়িকতার বাস্তব রূপ। কবির কাছে সবসময়ই তাঁর উপাস্য হয় তাঁর পাঠকবৃন্দ। পাঠকের মন কবির জন্য সবচেয়ে বড় তীর্থক্ষেত্র। সম্ভবত সে কারণেই হয়তো তাঁর একটি দোঁহাগ্রন্থ ‘নেহাই’ তিনি উৎসর্গ করেন প্রিয় পাঠকদের উদ্দ্যেশ্যে। গ্রন্থের অঙ্গসৌষ্ঠব ও কথামুখের কবিতাটি পাঠক হৃদয়ের জন্য উপরি পাওনা বলা যায়। হৃদয়গ্রাহী এ কবিতাটি এখানে তুলে দিলাম– ‘দোঁহা তিনিই লেখেন যিনি আমাকে একক/অনুরাগে ভালোবাসেন/আমি লিখতে বসি কারিকা নয়তো দোঁহা/অন্তঃপুরে তিনি হাসেন।/যদি বলি জানি জানি আমার ভেতরে তুমি/গড়িয়াছো চিরআবাস,/অকস্মাৎ দেখতে হয় ভারাক্রান্ত প্রকৃতি/থেমে গেছে, থির বাতাস/যদি বলি আছো গুরু, ভেতরের অবিকল/নাচো জগতের বাইরেও/হাসিয়া বলেন তিনি, কোজাগরি পূর্ণিমায়/নিরঞ্জন সাক্ষাতে যেয়ো।/…’

সন্ত কবীরের দোঁহাগুলোর পরিব্যাপ্তি ছিল দুই পঙক্তি বা ততোধিক। তাঁর দোঁহাকবিতাগুলো একসময় উপমহাদেশে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। ইউসুফ মুহম্মদের এই কবিতাগুলোও একইভাবে বা ততোধিক পঙক্তিতে বিন্যস্ত। এগুলোও পাঠকমহলে আলোড়ন তুলবে নিঃসন্দেহে। কবিতাগুলোর অন্তর্গত ভাবসৌন্দর্য এমন যে, বারবার এমনকি জীবনভর পড়েও তৃপ্তি মিটবে বলে মনে হয় না। এ কথার সমর্থনে এখানে ৩৭৪ সংখ্যক দোঁহাটি পাঠকের জন্য তুলে ধরলাম– ‘দেখা হলে কথা নয়, কথা হলে দেখা/ভার্চুয়াল জানালায় দেখি তোর লেখা,/নুরানি কলমে আঁক গোপী রূপকথা/যোগীর ললাটে ভজনের আকুলতা।/… জন্মজলের উষ্ণতাতুমি কোন্‌ নসিবের ঋতি/এই আছো এই নেইছুঁতে গেলে লিখে সারা ইতি।’ হৃদয় উদ্বেলিত করা দোঁহাগুলো এই প্রেমহীন মিথ্যা ভালোবাসার পৃথিবীতে সত্যিই যেন আগামী প্রেমের শাশ্বত চিহ্ন তৈরি করে রেখেছে। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াও।’ মানুষ আজ সত্যি অবক্ষয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যেখানে সম্পর্কের চেয়েও বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে হিংসা ও স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা। শক্তি আর সম্পদের লোভ কিছু কিছু মানুষকে প্রকৃতই অন্ধ করে দিয়েছে, তাই কবির দৃপ্ত উচ্চারণ ‘জীবন পোড়ানো ছাই উড়াইয়া ভুলেছি মানব সূত্র/আমরা খুঁজেছি কে রাম অথবা রহিমের মূল পুত্র।/ইউসুফ বলে, সত্য মানুষ নাভজিয়া যাও যদি গয়াকাশিমদিনা/নিজের মধ্যে পাবে না নিজেরে, হারাবে পন্থ মানুষ নাহও, যদি না। ক্রন্তিকালীন অবক্ষয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁর দোঁহা এভাবে ভোরের উষার মতো স্নিগ্ধতায় আমাদের শোনায় জাগরণ আর বেঁচে থাকার গান।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুঃখজাগানিয়াকে গান শোনাতে চেয়েছিলেন, ‘ওগো দুঃখজাগানিয়া তোমায় গান শোনাবো’ বলে। তেমনই ইউসুফের দোঁহা হতে পারে আমাদের মনখারাপের একান্ত সঙ্গী। পথ চলার পাথেয়। পথহারা পথিককে অন্ধকারে পথ দেখিয়ে চলতে কবি ইউসুফ মুহম্মদের দোঁহা ঠিক যেনো আলোর দিশা হয়ে উঠেছে। কবির ধর্মে ঘৃণা শব্দের স্থান নেই। হৃদয় মন্ত্রে প্রেমের সুর তোলাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। তাই তিনি তাঁর আরাধ্য সখীকে বলতে পারেন, তাঁকে ঘৃণায় দগ্ধ করলেও যেনো ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত না করেন। কবি তাঁর ২৭২ সংখ্যক দোঁহায় সে কথাই স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন– ‘কবিকে ঘৃণায় দগ্ধ করো/কবিতাকে ভালোবেসে দাও হৃদয় যন্ত্র,/কবি কলাকৃৎ জানে তোমাকে শেখাবে সুর।/বাৎসায়ণী গানে মধুমন্ত্র’।

প্রাচীন থেকে আধুনিক সব কবিতাতেই গাওয়া হয়েছে প্রেমের জয়গান। এই মিথ্যার পৃথিবীতেও তাই যেনো রামগিরি পর্বতের সেই দেবদত্ত নামের খোদাই কারিগর আর দেবদাসী সুতনুকার প্রেম অমরভাবে ফিরে এসেছে কবির ২৮৫ সংখ্যক দোঁহায়– ‘প্রচীন পাথর থেকে লিপি উদ্ধারের ছিলো পেলব প্রস্তুতি/খননের শুরুতেই কেনো গেয়ে ওঠো কামারের প্রিয়স্তুতি’।

চিত্তাকর্ষক এ দোঁহাগুলোকে বলা যায় একুশ শতকের উৎকৃষ্ট এক ফসল। প্রেমপ্রকৃতিসমম্বয়বাদ আর স্বপ্নের পালে হাওয়া দিয়ে এগিয়ে চলুক দোঁহা নামের তরিটি। গ্লানির অবসান ঘটিয়ে বয়ে আনুক সুন্দরের বার্তা।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, বাংলা বিভাগ, ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআশা ও অনিশ্চয়তার সন্ধিক্ষণে ব্যাংকিং খাত
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষাব্রতী আচার্য যোগেশ চন্দ্র সিংহ