দেশে ধর্মীয় সহিংসতা রুখতে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশের সব জেলা-উপজেলায় গঠন করা হয়েছে ‘সামাজিক সমপ্রীতি কমিটি’। জেলা পর্যায়ের কমিটিতে সভাপতি রাখা হয়েছে জেলা প্রশাসককে (ডিসি)। ২৩ সদস্যের কমিটিতে সংশ্লিষ্ট জেলার সব সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের প্রশাসককে উপদেষ্টা রাখা হয়েছে। আর পুলিশ সুপারকে রাখা হয়েছে সদস্য হিসেবে। জেলার পাশাপাশি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও আলাদা সামাজিক সমপ্রীতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপজেলা কমিটির নেতৃত্বে রাখা হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও)। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ২৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আলাদা তিনটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। উপজেলা পর্যায়ের কমিটি ২৪ সদস্যের। এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ইউএনওকে। ওই উপজেলার সংসদ সদস্যকে রাখা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে করা হয়েছে উপদেষ্টা। আর ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি ১৪ সদস্যের। এ কমিটির প্রধান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। সদস্যসচিব করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সচিবকে। কমিটির কাজ কী হবে, তা-ও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। আলাদা তিনটি কমিটির সদস্যরা তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় সমপ্রীতি সমাবেশ করবেন। ধর্মীয় উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদকে প্রতিহত করতে প্রয়োজনীয় প্রচার কার্যক্রম চালাবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার রোধে মানুষকে সচেতন করে তুলবেন। মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ সব উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কমিটি সহযোগিতা করবে। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, সব ধর্মীয় উৎসব যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে উদ্যাপনের পরিবেশ ভালো রাখতে এসব কমিটি কাজ করবে। বিভিন্ন ধর্মের শান্তি ও সৌহার্দ্যের বাণী প্রচারের ব্যবস্থা করবে এসব কমিটি।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সমপ্রীতিহীনতার ফলে সমাজে অস্থিরতা, অনৈক্য ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আর দ্বন্দ্ব থেকেই সূত্রপাত হয় সহিংসতার এবং অব্যাহত সহিংসতা জাতিকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
আসলে বর্তমান বিশ্বে যা হচ্ছে, বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। বহুকাল আগে থেকেই বাঙালির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতা ছিল, সেটা একপ্রকার ধ্বংস করা হয়েছে। ওই মানসিকতা আমাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে। সামাজিক সমপ্রীতি বজায় রাখতে গেলে আমাদের সমপ্রীতি নষ্টের মূল কারণ উদঘাটন করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের গ্রামগুলোতে সামাজিক পুঁজি গড়ে তুলতে না পারলে সমপ্রীতি নষ্ট হয় এমন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকবে। চাতুর্যের মধ্য দিয়ে সমাজে সমপ্রীতি রক্ষা করা যায় না। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক সমপ্রীতির মাধ্যমে ‘সামাজিক পুঁজি’ সৃষ্টি হয়। সামাজিক পুঁজি আর্থিক পুঁজি থেকে ভিন্ন এবং এটি সৃষ্টি হয় যখন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। সামাজিক পুঁজি আর্থিক পুঁজির অপ্রতুলতা দূর করতে পারে। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘সামাজিক আন্দোলন’ ও ‘সামাজিক প্রতিরোধ’ গড়ে তোলা গেলে অনেক সামাজিক সমস্যারই অর্থকড়ি ছাড়াই সমাধান সম্ভব হয়। তাই অর্থনৈতিক দিক থেকে দরিদ্র দেশগুলোয় সামাজিক সমপ্রীতিই বড় পুঁজি হিসেবে দেখা দেয়।
বদিউল আলম মজুমদার তাঁর এক লেখায় বলেছেন, সমাজে সমপ্রীতিহীনতা, দ্বন্দ্ব ও সহিংসতার উৎস সাধারণত দুটি: ‘আইডেনটিটি-বেইজড প্রিজুডিস’ বা পরিচয়ভিত্তিক বিদ্বেষাত্মক মনোভাব এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও দলাদলি। একটি সমাজে সাধারণত ভিন্ন ও স্বতন্ত্র ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতিসত্তা ও ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করে। সমাজে এ ধরনের ভিন্নতাই ‘প্লুরালিজম’ বা বহুত্ববাদের ভিত্তি। বহুত্ববাদী সমাজে সামাজিক সমপ্রীতি বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন সমাজে পরিচয়ভিত্তিক ভিন্নদের সম্পর্কে বিরাজমান ও সম্ভাব্য পূর্ব ধারণা বা বিদ্বেষাত্মক মনোভাবের অবসান ঘটিয়ে সবার জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। আর ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা সামাজিক আত্মীকরণের মাধ্যমেই এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। যেকোনো সমাজেই পরিচয়ভিত্তিক বৈচিত্র্য বা ‘ডাইভারসিটি’ একটি বাস্তবতা। এমনি বাস্তবতায় প্রয়োজন পূর্বধারণাগত বিদ্বেষ দূরীকরণের লক্ষ্যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সমপ্রীতি গড়ে তোলা।
সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ন রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের মধ্যে কমিটি গঠনের কার্যক্রম অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। আশা করি, সরকার বর্তমান সহিংসতার চক্র ভেঙে সামাজিক সমপ্রীতি বজায় ও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।