সমকালের দর্পণ

হারানোর বেদনার্ত এই দিন

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের সেই দিন সেই সময় বাঙালি জাতি তার স্বাধীনতা অর্জনের দ্বার প্রান্তে। দীর্ঘ নয় মাসের বাঙালি জাতির অকুতোভয় প্রবল সংগ্রামের, অকাতর আত্মদানের ফল স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের উষালগ্ন। পাকিস্তানী সামরিক জান্তাও টের পায় তারা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে তারা সিদ্ধান্ত নেয় বাঙালিরা স্বাধীন হলেও তাদের মেধায়, মননে, শিল্প সাহিত্যে, অগ্রগামী চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে পঙ্গু করে দিতে হবে। এর পিছনে হয়ত যুক্তি ছিল স্বাধীন বাঙালি জাতি যেন স্বাধীনতা উত্তর পথ চলতে দিশাহীন হয়ে পড়ে। না হলে যেসব মানুষ স্বীয় বুদ্ধিবৃত্তি, সৃষ্টিশীলতা ছাড়া অন্যকোনও বিষয়ে কখনো কোথাও অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ করেনি তারা কেন হন্তারকদের শিকারে পরিণত হবে। এইসব মানুষেরা তো কারো সাথে কোনও সংঘর্ষ সংঘাতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেনি। মানুষের মঙ্গল, মানুষের মধ্যে মানবতা, মননশীলতা জাগ্রত করাই ছিল এদের ব্রত।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সামরিক জান্তা তাদের দোসরদের বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যায় লেলিয়ে দেয়। আলবদর অবিধায় অবিষিক্ত ঘাতকরা মুখোশের আড়ালে রাতের অন্ধকারে নেমে পড়ে তাদের শিকারের সন্ধানে।

এই শিকারের লক্ষ্যবস্ত্তু বাঙালি জাতির শীর্ষ স্থানীয় শিক্ষক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ কোন পেশাই বাদ ছিল না।

এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা সাহিত্যের দিকপাল নাট্যকার শিক্ষক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ইংরেজী সাহিত্যের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক হুমায়ূন কবীর, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহম্মেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মাহি, অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র, অধ্যাপক সাইদুল হাসান, সুরকার সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ, দার্শনিক অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র, অনুসন্ধানী সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন আহাম্মেদ, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, খ্যাতিমান চিকিৎসক অধ্যাপক ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক ড. আলীম চৌধুরী, খ্যাতিমান ঔপান্যাসিক শহীদুল্লা কায়সার উল্লেখযোগ্য।

ঘাতকরা চরম নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতায় এইসব শিক্ষক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞকে একে একে তুলে আনেন। অসহায় স্ত্রী সন্তান সন্ততি, বাবা মা’ ভাইবোনের আহাজারির মধ্যে, শত আকুতি মিনতিকে উপেক্ষা করে এদের একেকজনকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় নেওয়া হচ্ছে নিকটজনরা কিছুই জানতে পারেনি, জানত শুধু ঐ সব নরপিশাচরা।

রাত গভীর হয়। অজানার উদ্দেশ্যে তুলে নিয়ে যাওয়া অসহায় মানুষ গুলোর ঘরে ঘরে পরিজনদের উৎকণ্ঠা বাড়ে। কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এমন একজন জ্ঞানবান মুনির চৌধুরীকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে অমন একজন নির্বিবাদ দার্শনিক অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্‌্রকে? কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে অমন একজন সুরকার আলতাফ মাহমুদকে যার সুরে বাঙালি জাতি তার ভাষা শহীদদের স্মরণ করে ২১ শে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ আর চোখে অশ্রু ঝরায় কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে ড. ফজলে রাব্বি ড. আলীম চৌধুরীকে? কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন আহাম্মেদকে? এদের কী অপরাধ কেউ জানে না, যারা তুলে নিয়ে গেছে তারা সামান্যতম গরজও অনুভব করেনি তুলে নিয়ে যাওয়াদের স্ত্রী সন্তান সন্ততি, বাবা মা’ ভাইবোন পরিজনদের জানানোর। কী এক দুঃসময় ছিল সেই সময়!

সেই সময় স্বজন নিখোঁজ হওয়া মানুষগুলির অধিকার ছিল না প্রিয়জনদের কেন তুলে নেওয়া হল তা জানার!

সেই সময় এমনই দুঃসময় ছিল নিজের জীবনের উপর অধিকার দাবীর কোনও পথ ছিল না!

ঘরে ঘরে ঘুমহীন উৎকণ্ঠিত পরিবার পরিজনরা দুঃসহ সময় কাটিয়েছেন। প্রার্থনায় আকুল থেকেছেন তুলে নিয়ে যাওয়া স্বজনদের, প্রিয় মানূষগুলির নিরাপত্তায়।

পরদিন ১৫ ডিসেম্বর চরম উৎকণ্ঠার দিন, কী হয় কী হয়! ঘরের বের হয়ে এদের খুঁজতে যাবেন সেই সুযোগও কেউ পাননি। যুদ্ধের তীব্রতা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। হানাদাররা ক্রমান্বয়ে পরাজয়ের খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মানসপটে অপকীর্তির এবং পরাজিত এক ভবিষ্যৎ গ্লানিময় জীবনের ছবি আঁকা শুরু করে।

১৬ ডিসেম্বর হানাদারদের জন্য সেই গ্লানিময় সময় বয়ে আনে। বাঙালি জাতির বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ।

বিজয়ের এই সুবর্ণ সময়ে বাঙালি জাতি জেনে যায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে কী নৃশংসতা, কী নির্মমতা, কী পৈশাচিকতা, কী বর্বরতা সংঘটিত হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যের দিকপাল নাট্যকার শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ইংরেজী সাহিত্যের জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক হুমায়ূন কবীর, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, পর্দাথ বিজ্ঞানের অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহম্মেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মাহি, অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র, অধ্যাপক সাইদুল হাসান, সুরকার সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ, দার্শনিক অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র, অনুসন্ধানী সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন আহাম্মেদ, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, খ্যাতিমান চিকিৎসক অধ্যাপক ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক ড. আলীম চৌধুরী, খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক শহীদুল্লা কায়সাররা পড়ে আছে অনাদরে।

প্রায় সবারই হাত পা বাঁধা, সারা শরীরে আঘাতের ক্ষত চিহ্ন, কারো কারো চোখ উৎপাটিত। এই সব মানুষ গুলির অপরাধ কি ছিল? উৎসুখ শোর্কাত মানুষদের মনে প্রশ্ন জাগে। এদের অপরাধ ছিল এরা জ্ঞান পিপাসু ছিলেন। এদের অপরাধ ছিল এরা অর্জিত জ্ঞান অন্যদের মাঝে বিতরনে তৎপর ছিলেন। এদের অপরাধ ছিল এরা বাঙালি জাতির মানস গঠনে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। এদের অপরাধ ছিল এরা বাঙালি জাতির মেধা মনন স্ফুরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিলেন।

এবার ব্যক্তিগত একটি হারানোর বেদনার কথা তুলে ধরে এ লেখাটি শেষ করব।

এপ্রিল ৭১ এর প্রথম সপ্তাহ আমার মামা জনাব সিরাজুল হক রেলওয়ের মাঝারি মানের গুরুত্বপূর্ণ অফিসার ছিলেন। তিনি মার্চ থেকে আর অফিসে যাননি। আমবাগানের বাসাতেই দিন কাটাচ্ছিলেন। একদিন কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য আর সশস্ত্র বিহারী এসে আমার সিরাজ মামার বাসায় হাজির হয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের দেখিয়ে বিহারীরা বলে ‘আপনাকে তাদের সাথে যেতে হবে’। কোন বাধানুবাদ না করে সিরাজ মামা প্যান্ট সার্ট পরে তৈরি হয়ে নেন। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকেন স্থানুর মত কলেজ পড়ুয়া বড় ছেলে, স্কুলগামী দুই মেয়ে, ছোট ছেলে আর স্ত্রী।

ঘণ্টা খানেক পর সিরাজ মামাকে যারা নিয়ে গেছে সেই দল আবার আসে, সাথে আরো কয়েকটি নতুন মুখ। আবারো দরজায় বেলের শব্দ। এবার দরজা খোলে ঘরের বড় ছেলে আমার মামাত ভাই মিরাজুল হক। দরজা খোলার সাথে সাথে আগতরা অনেকটা টেনে হেঁচড়ে মিরাজকে নিয়ে যায়।

রাত গভীর হয়। আমার সিরাজ মামার ঘরে কারো চোখে ঘুম আসে না। মাঝ রাতে বর্বরদের ঐ দল আবার আসে। আবারো হানা দেয় সিরাজ মামাদের বাসায়। এবার দরজা খোলে ঘরের ছোট ছেলেটি এগার বছরের সুবর্ণ। সুবর্ণের চোখে নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি। আগত হায়েনার দল সুবর্ণকে জিজ্ঞেস করে তোমার বাবা কোথায়।

ছোট মানুষ অবলীলায় বর্বরদের মুখের উপর জবাব দেয় কেন বাবাকে তো তোমরাই নিয়ে গেছ। আগতদের একজন ছিল সুবর্ণদের পড়শী ওকে ও চিনেও ফেলে। সেটাই হয়ত সুবর্ণের জন্য কাল হয়। ঐ পিশাচের দল সুবর্ণকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নেয়। সুবর্ণ আর্তচিৎকারে মাকে ডাকে। মা দৌড়ে আসে ছেলেকে বাঁচাতে। বাইরে যাওয়ার কোনও উপায় নাই। দরজায় দুই পাকিস্তানী উনার পথ আটকে দেয়। মা ছেলের আর্তনাদ শুনে ‘মা আমাকে ওরা মেরে ফেলছে’। অতটুকু ছেলের আর্ত চিৎকার শুনে আমার মামীও আর্তনাদ করেন। কিছুক্ষণ পর সুবর্ণ’র আর কোন শব্দ পাওয়া যায়নি। আমার মামী ঘরের দরজা বন্ধ করে দুই তরুণী মেয়েকে নিয়ে কাঁদেন আর আল্লাহর নাম জপতে থাকেন সাথে দুই মেয়েও।

শেষ রাতে মানুষরূপী ওরা আবার আসে, দরজায় বেল টিপে। আমার মামী আর দুই মামাতো বোন এই তিনটি বিধ্বস্ত প্রাণীর কেউ দরজা খোলার সাহস করে না। শানু আমার মামাতো বোনবাবা, ভাইরা ফিরছে কিনা আঁচ করতে দরজার কাছে কান পাতে। তখনই শানু কিছু বুঝে উঠার আগে ওরা দরজার নিচে ফ্লোরে গুলি করে। গুলি রিকোশিয়েট করে স্পিলিন্টার ঢুকে পড়ে শানুর পায়ে। ফিনকি দিয়ে শানুর গোড়ালীর থেকে রক্ত বের হতে থাকে। ভোর হয়। আমার মামী শানুকে নিয়ে রেলওয়ে হাসপাতালে যান। ডাক্তার শানুকে ব্যান্ডেজ করে দেন কিন্তু গুলি খাওয়া রোগী বলে ভর্তি করতে অস্বীকার করেন।

আমার বড় চাচার ছেলে আমিনুল ইসলাম উনীও তখন রেলওয়েতে চাকরি করতেন। খবর পেয়ে মামার বাসায় হাজির হন। মামী হাসপাতাল থেকে শানুকে নিয়ে ফিরে আসেন। আমিন ভাই মামী আর দুই মামাতো বোনকে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বলেন। মামী কোন কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজী নন। তার আশা স্বামী আর তার ছেলেরা যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসবে। আমিন ভাই মামীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বুঝান হায়েনাগুলো আজকে রাতে আবারও আসতে পারে। এই দুই মেয়ে নিয়ে তখন আপনি কি করবেন? আমিন ভাইয়ের গাড়িতে উঠার আগে বাড়ির অদূরে সেফটি ট্যাংকটি দেখিয়ে মামী বলে উঠেন আমিন দেখত আমার ছেলেটিকে মেরে ওরা ঐ ট্যাংকে কোন ফেলে দিয়েছে কিনা? আমিন ভাই মামীর পীড়াপিড়িকে বাড়াবাড়ি মনে করে সেফটি ট্যাংকের কাছে গিয়ে দেখেন। আমিন ভাই ফিরে এসে মামীকে বলেন, না ওখানে কিছু নাই। গাড়ি চেপে মামী, দুই মামাতো বোন আর আমিন ভাই আমাদের বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেন। গাড়ি চলতে থাকে, আমিন ভাই আকাশের দিকে মুখ করে বিড় বিড় করেন আল্লাহ আমি এ কি দেখেছি।

মামীদের আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে জরুরি কাজে আমিন ভাই ফিরে আসেন আমবাগানের সেই বাসাতে। আশে পাশের কয়েকজন লোককে ডেকে সেফটি ট্যাংক থেকে তুলে আনেন এগার বছর বয়সের অমন মায়াবী চোখের সুবর্ণের লাশ। আমার মামী কখনো জানেনি তার অজান্তে তার ছেলেকে কবরস্থ করা হয়েছে, উনী শুধু বাকী জীবন জেনেছেন উনার স্বামী, বড় আর ছোট ছেলে একদিন ফিরে আসবেন। আমার মামীর জীবতকালে এরা কেউ ফিরেনি। আর এখনও না।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. জাকির ও তাঁর চিকিৎসাসেবা
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করা হলে জনরোষ থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না