সমকালের দর্পণ

গণহত্যা আর ধ্বংসলীলার বিচারবিহীন গাজা শান্তি চুক্তি

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ

পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সংঘাত সংঘর্ষ কেন? গত পর্বের লেখায় এই সংক্রান্ত দ্বিতীয় পর্ব আজ মুদ্রিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত্তু পাঠকদের আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আজ গাজা’র শান্তি চুক্তির বিষয়ে লেখার জন্য মনস্থির করি। ফলশ্রুতিতে গাজা শান্তি চুক্তি নিয়ে আজকের আলোচনা। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাস ইসরাইলীদেন উপর অতর্কিত এক হামলা পরিচালনা করে। এ হামলায় মোট ১১৯৫ জন নিহত হন। ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। নিহতদের মধ্যে ৮১৫ জন ছিলেন বেসামরিক এবং বাদবাকীরা সামরিক। এ ঘটনার পরপর ১৩ অক্টোবর ২০২৩ ইসরাইল গাজার উপর প্রচণ্ড বিমান আক্রমণ এবং ২৭ অক্টোবর একই বছর সামরিক অভিযান শুরু করে।

এই সামরিক অভিযান ছিল মানব ইতিহাসের বর্বরতম। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ বেদনার্ত চিত্তে সে দৃশ্য অবলোকন করেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা তথা এই পৃথিবীর মানুষেরা যাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বিশেষ করে তরুণ শ্রেণি তারা রাস্তায় নেমে ইসরাইলী অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছে। যারা প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে পারেনি তারা তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে ইসরাইলী বর্বরতার বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেছে। সংবেদনশীল মানুষদের এই প্রতিবাদ এই ঘৃণা ছিল গাজার উপর ইসরাইলের নির্বিচার নির্বিকার বোমা বর্ষণের বিরুদ্ধে। যে বোমা বর্ষণে জনপদের পর জনপদ নিঃশ্চিহ্ন হয়েছে। ইসরাইল মানুষের জন্য খাদ্যাভাব সৃষ্টি করে মানুষকে অভূক্ত রেখে খাদ্যের জন্য জিম্মি করেছে।

ইসরাইল মানুষকে আলো বঞ্চিত করে অন্ধকারে ক্রমাগত বন্দী করে রেখেছে।

সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করে মানুষকে শিক্ষাচিকিৎসা বঞ্চিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা করেছে ইসরাইল।

খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে খাদ্যের লাইনে দাঁড় করিয়ে বয়স নির্বিশেষে গুলি করে মেরেছে। এটার নাম ‘Weponizing hunger’ ‘হত্যার হাতিয়ার খাদ্য’। মানুষ কী হতভাগ্য। পান যোগ্য পানির সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে ইসরাইল মানুষকে পিপাসায় কাতর করছে। এই একবিংশ শতাব্দীতে গণহত্যার শিকারে পরিণত করে হাজারো মানুষকে নাম পরিচয়হীন গণকবরে অনাদরে শায়িত করেছে ইসরাইল ।

একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতাদর্পী মানুষের সামনে ইসরাইল মানুষকে তার পুরুষানুক্রিমক বসতি থেকে উচ্ছেদ করে উদ্বাস্ত্তু করছে। অভুক্ত অপুষ্টিতে শিশুরা মরেছে মায়ের কোলে, মায়েরা জন্ম দিয়েছে নিষ্পাপ সন্তান যেন মৃত্যুর জন্য।

ইসরাইলের পক্ষে এই নির্মমতা, এই আলোহীনতা, এই দুর্ভিক্ষ পীড়ন, এতসব বিভৎস হত্যাযজ্ঞ, এত হৃদয়হীন মৃত্যুর মিছিল আয়োজন সম্ভব হয়েছে ফ্রান্সেসকা আলব্যানেজ’ এর মতে কর্পোরেট এনটিটি তথা বহু জাতিক সংস্থাগুলির পুঁজিবাদী মানসিকতার উদগ্র লালসা এবং ফলশ্রুতিতে ইসরাইলকে অসংকোচ সমর্থন।

ইসরাইল আমেরিকার বাইরে প্রথম দেশ যারা ২০১৮ সালে এফ৩৫ যুদ্ধ বিমান আকাশে উড়িয়েছে ফিলিস্তিনীদের হত্যার উদ্দেশ্যে। ইরানের বিরুদ্ধেও এই এফ৩৫ যুদ্ধ বিমান আকাশে উড়েছে। আমেরিকান কোম্পানী ‘লকহীড মার্টিন’ এ যুদ্ধ বিমানের নির্মাতা। এফ৩৫ যুদ্ধ বিমান ১৮০০০ (আঠার হাজার) পাউন্ড পর্যন্ত গোলাবারুদ নিয়ে লক্ষ্যবস্ত্তুতে নির্ভুল আঘাত হানতে অব্যর্থ। এ যুদ্ধবিমান পাওয়াতে ইসরাইল র্স্বক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই এফ৩৫ এবং এফ১৬ যুদ্ধবিমান গত এক বছরে গাজায় ৮৫,০০,০০০ (পঁচাশি হাজার) মেট্রিক টনেরও বেশি বোমা বর্ষণের মাধ্যমে ১৭৯,৪১১ (এক লক্ষ ঊনাশি হাজার চারশত এগার) জন ফিলিস্তিনীকে মারাত্মক আহত এবং হত্যা করেছে। আমেরিকা যেহেতু ইসরাইলকে এই যুদ্ধ বিমানের যোগানদাতা এবং ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মদদ দাতা সেক্ষেত্রে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বসম্প্রদায় যতবারই কোন ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছে আমেরিকার ‘ভেটো’ পাওয়ার তথা ক্ষমতার জোরে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

এমনই প্রেক্ষাপটে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। ‘ইমপ্লিমেনটেশন স্টেপস ফর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফর এ কম্প্রেয়েনসিভ এনড অব গাজা ওয়ার’ শিরোনামের ২০ দফার এ প্রস্তাব অবশেষে ৯ অক্টোবর ২০২৫ মিশরের শরম আল শেখ’এ স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছাড়া ও মিশরীয়, তুর্কি প্রেসিডেন্টদ্বয় এবং কাতারের প্রধানমন্ত্রী এ চুক্তির নিঃশ্চয়তা দাতা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। এর বাইরেও বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ২৭ জন সরকার প্রধানকে মিশরীয় প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে ঐ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে উপস্থিত করানো হয়।

ইমপ্লিমেনটেশন স্টেপস ফর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফর এ কম্প্রেয়েনসিভ এনড অব গাজা ওয়ার’ শিরোনামের ২০ দফার এ প্রস্তাবে যা রয়েছে তা আমি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

১। গাজা সন্ত্রাস এবং প্রতিবেশীদের প্রতি হুমকিমুক্ত একটি অঞ্চল হবে। ২। গাজাকে গাজার মানুষ যারা বর্ণনাতীত দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন তাদের কল্যাণে পুনর্গঠিত করা হবে। ৩। উভয় পক্ষ সম্মত হলে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। ইসরাইলী বাহিনী বন্দীমুক্তির সুবিধার্থে একটি সম্মত নির্দিষ্ট সীমারেখায় প্রত্যাহৃত হবে। এই সময়ের মধ্যে সকল প্রকার বিমান, গোলন্দাজ আক্রমণ বন্ধ থাকবে, যুদ্ধ বিদ্যমান সীমারেখায় নিরাক্রমণ অবস্থায় স্থিত থাকবে। এ অবস্থা প্রস্তাবিত সকল শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহার পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। ৪। ইসরাইল কর্তৃক এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত এবং মৃত সকল বন্দীর মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৫। সকল বন্দীর মুক্তি সাপেক্ষে ইসরাইল ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে তাদের কারাগারে থাকা ১৭০০ গাজাবাসীকে মুক্ত করে দিবে। ইসরাইলী মৃত জিম্মিদের প্রত্যার্পণ করার সাথে সাথে ইসরাইলও গাজার ১৫ মৃত বন্দীর লাশ গাজা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে। ৬। সকল বন্দী বিনিময়ের পর হামাসের যেসব সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনে ইচ্ছুক হবেন তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হবে। হামাসের যেসব সদস্য গাজা ত্যাগ করে অন্যকোন দেশে চলে যেতে ইচ্ছুক হবেন তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে। ৭। এ চুক্তি গ্রহণের পর গাজায় পূর্ণভাবে সব ধরনের সাহায্যের হাত বাড়ানো হবে। এই সহায়তা হাসপাতাল পুননির্মাণ, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, ধ্বংস্ত্তূপ সরানোর জন্য সরঞ্জমাদি প্রেরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ৮। সাহায্য প্রেরণ এবং বিতরণে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না। এটি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্টে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ৯। গাজায় একটি প্যালেস্টাইনীয়ান অরাজনৈতিক টেকনোক্রেটিক এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ গাজার মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দিকগুলো দেখবেন। ‘দি বোর্ড অব পিস’ নাম দিয়ে গাজার জন্য গঠিতব্য এই বোর্ডের প্রদান হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, এই বোর্ডে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদেরও মনোনয়ন দেওয়া হবে। এই বোর্ড গাজার উন্নয়ন সাধন, পৃথিবীর যেকোন উন্নত শহরের মত প্রশাসনিক এবং আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করবেন। এই কাজের মাধ্যমে পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় বিনিয়োগকারীদের গাজায় বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করবেন। ১০। মধ্যপ্রাচ্যের প্রাণচঞ্চল শহর গুলির মত গাজার মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান, উন্নত জীবনমান সৃষ্টিতে ‘দি বোর্ড অব পিস’ কাজ করবে। ১১। গাজায় একটি বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হবে। এখানে ট্যারিফ ইত্যাদি বিনিয়োগকারী দেশগুলির সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হবে। ১২। গাজা থেকে কাউকে জোর করে বের করে দেওয়া হবে না। কেউ গাজা ছেড়ে চলে যেতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া হবে না। আবার বের হয়ে ফেরত আসতে চাইলে তাকেও বাধা দেওয়া হবে না। গাজার মানুষদের তাদের ভাগ্য গড়ার জন্য উৎসাহিত করা হবে। ১৩। হামাস গাজার প্রশাসনে কোন প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বা অন্য যেকোন প্রকার অংশগ্রহণে জড়িত না থাকার সম্মতি প্রদান করেছে। গাজার সকল প্রকার সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রপাতি, টানেল ধ্বংস করা হবে। গাজাকে সম্পূর্ণ অস্ত্রমুক্ত করতে বিদ্যমান অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজনে ক্রয় করা হবে। এটি একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনায় সম্পাদন করা হবে। গাজার মানুষের মূল লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। ১৪। আঞ্চলিক অংশীদাররা হামাস কখনো প্রতিবেশীর জন্য কোন ধরনের হুমকি সৃষ্টির বিরুদ্ধে নিশ্চয়তা প্রদান করবেন। (চলবে)

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসামাজিক মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল সমাজের অন্ধকার দিক
পরবর্তী নিবন্ধকয়েক সপ্তাহ ফুরফুরে মেজাজ, দাম কমায় এখন দুশ্চিন্তা