১৫ আগস্ট ২০২৫ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ বন্ধে এক ঐতিহাসিক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় আলাস্কায়। এই আলাস্কা একসময় রুশ সম্্রাটের সম্পত্তি ছিল, তিনি তা আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এখন দুদেশের মাঝে রয়েছে বেরিং প্রণালী। বেরিং প্রণালীর সূত্রে আমেরিকান আলাস্কা’র ক্যাপ প্রিন্স আর রাশিয়ার ক্যাপ দেজনেভ এর মধ্যে রয়েছে মাত্র ৫১ (একান্ন) মাইল দূরত্ব। এই সুযোগে আলাস্কায় অবতরণ করে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সম্বোধন করেন ‘হ্যালো নেইবার’ অর্থাৎ হে প্রতিবেশী। এ থেকে ঐ সম্মেলনের একটি আন্তরিক আবহের ইঙ্গিত পর্যবেক্ষকরা আঁচ করতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুতিনকে লাল গালিচা সংবর্ধনার মাধ্যমে বরণ করে নেন। দুজন এমনিতেই দীর্ঘদিন থেকে কাছের মানুষ। মধ্যখানে শুধু রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মেদভেদভের কথার জবাব দিতে ট্রাম্প ক্ষেপে গিয়ে রাশিয়া অভিমুখি দুটি পারমাণবিক যুদ্ধ জাহাজ প্রেরণ করেছিলেন। মেদভেদভের সে কথা ছিল ন্যাটোর উদ্দেশ্যে, তিনি বলেছিলেন ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে ন্যাটো যেসব উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তাতে রাশিয়া তার মিসাইল নিয়োজনের যে সীমারেখা তার বাইরে গিয়েও তা নিয়োজিত করবে। মেদভেদভের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পারমাণবিক সাবমেরিনগুলিকে রাশিয়ার কাছাকাছি অবস্থানে অবস্থান নিতে বলেছিলেন। ট্রামের এই আদেশের বিপক্ষে তার এক সময়ের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বল্টন মন্তব্য করেন ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নৌ শক্তি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানেন না’। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প’এর সাবমেরিন কাণ্ডের প্রতি উত্তরে সাথে সাথে রাশিয়া এবং চীন ভ্লাডিভস্টকে যৌথ নৌ মহড়া পরিচালনা করে। এই মহড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাবমেরিন শনাক্ত এবং ধ্বংসকরণ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীন–রাশিয়ার এই মহড়া থেকে একটি বার্তা পেয়ে থাকবেন হয়তো।
আলাস্কায় শীর্ষ বৈঠকের আগে আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ না করলে তাকে চরম পরিণতির হুমকি দিয়েছিলেন। একই সাথে রাশিয়া থেকে ক্রুড আমদানীর কারণে ভারতের উপর ট্যারিপ ২৫% থেকে বাড়িয়ে ৫০% এ উন্নীত করেন। এসব বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের সচেতন পর্যবেক্ষকদের ধারনা ছিল ট্্রাম আলাস্কায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে হয়ত কঠোর একটি অবস্থান গ্রহণ করবেন।
বাস্তবে এর কিছুই হয়নি। বরং দু পক্ষের বৈঠক ছিল আগাগোড়া পুতিনময়। এর পিছনে কারণও রয়েছে। পুতিন এই আলোচনা বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন অনেকটা বিজয়ী বীরের বেশে। এর কারণ–
ক। রাশিয়ার উপর আমেরিকাসহ পশ্চিমের সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে রাশিয়া অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করেছে। খ। অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়া তার পূর্ব অবস্থানকে আরো সুসংহত, মজবুত এবং শক্তিশালী করেছে। গ। চীন –ভারত–ইরান এবং ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশীয় অনেক দেশকে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়া বিশ্বকে অনেকটা শীতল যুদ্ধকালীন ‘বাইপোলার’ তথা শীতল যুদ্ধকালীন স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ঘ। রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রগুলিকে সফলভাবে মোকাবেলা করে দুর্দান্তভাবে প্রত্যাঘাত করেছে। ঙ। ন্যাটোসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাশিয়া সমর ক্ষেত্রে ইউক্রেনের প্রায় ৩০% ভূমি দখল করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য প্রর্দশন করেছে। চ। পুতিনের সুদৃঢ় নেতৃত্ব রাশিয়াকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে। এসব কারণে আলাস্কায় পুতিন ছিলেন প্রত্যয়ী এবং ট্রাম্পের চেয়ে প্রভাবশালী। হয়ত সে প্রভাবের কারণেই ট্রাম্প পুতিনকে আলাস্কায় যুদ্ধ বিরতিতে চাপ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং পুতিনের সাথে কোনও ধরনের শান্তি চুক্তিতে উপনীত হতে পারেননি। অন্যদিকে আলাস্কায় ট্রাম্পের দুর্বল অবস্থানের কারণ–
ক। প্রথমত ট্রাম্প নিজদেশ আমেরিকার জন্য নয় বরং অন্যদেশ ইউক্রেনের পক্ষ হয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্রতী হয়েছেন। অন্যদেশের স্বার্থ নিয়ে সন্ধি ট্রাম্পকে নিশ্চিত মনস্ত্তাত্বিক একধরনের চাপে রেখেছিল। খ। রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রযাত্রা বন্ধে ট্রাম্পের কাছে কোনও উপায় ছিল না। গ। আলোচনায় তাকে ইউরোপিয় মিত্র যেমন জার্মানী, ফ্রান্স, বৃটেন, ইটালী এবং সবার উপরে ইউক্রেনের কথা মাথায় রাখতে হয়েছে যা আলোচনার টেবিলে তাকে দুর্বল এক অবস্থানে চেপে রেখেছিল। ঘ। আরো একটি জিনিস যা তিনি কোন ধরনের রাখডাক না করে ফঙ নিউজের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেই ফেলেছেন, রাশিয়ার রয়েছে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং উন্নত সমরাস্ত্র।
এসব কারণে ট্রাম্প আলাস্কায় কোন শান্তি চুক্তি বা যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছাতে সক্ষম হননি। বরং আলোচনা শেষে তিনি বলেন, আমাকে এখন অনেকের সাথে কথা বলতে হবে। তিনি কথা বলেছেন, ন্যাটোর সাথে, জার্মান চ্যান্সেলর, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী, ইতালীর প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সাথে।
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে এক সময় এদের সম্মিলিত লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে পরাজিত করা। এই উদ্দেশ্যে আমেরিকা ইউক্রেনকে দিয়েছে ৩০০ (তিনশত) বিলিয়ন ডলার, ইউরোপিয় ইউনিয়নের শরীকরা দিয়েছে ১০০ (একশত) বিলিয়ন ডলার। ইউরোপিয় নেতারা যখন বুঝতে পেরেছেন তারা রাশিয়াকে পরাজিত করার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার প্রায় চুড়ান্ত সীমায় যখন পৌঁছে যাচ্ছেন তখন ইউক্রেন যুদ্ধে বিরতি এবং শান্তিচুক্তির জন্য ট্্রাম্পের কাঁধে সোয়ার হয়েছেন। যার জন্য আলাস্কা শীর্ষ বৈঠকের পরপর কালক্ষেপণ না করে সবাই ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজে ধর্ণা দিতে পৌঁছে যান।
এটা নিশ্চিত ইউরোপিয় নেতারা রাশিয়ার দিক থেকে বিপদ আঁচ করে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইতে হোয়াইট হাউজে একত্রিত হয়েছেন এতে কোনও সন্দেহ নেই। হোয়াইট হাউজে তারা সম্মিলিতভাবে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দাবী জানান ট্রাম্পের কাছে প্রকারন্তরে এ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা মূলত তাদের জন্যও।
এ নিয়ে ট্রাম্প পুতিনের সাথে জেলেনেস্কির বৈঠক আয়োজনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার অনাগ্রহ বড় বাধা হবে সেটি স্পষ্ট। এ প্রেক্ষাপটে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকই অনুষ্ঠিত হবে হয়তো।
ত্রিপক্ষীয় সে বৈঠকে যুদ্ধ বিরতি বা শান্তিচুক্তি যেসব শর্তকে সামনে রেখে আলোচিত বা সিদ্ধান্ত হবে তার একটি ধারনা ইতিমধ্যে ওয়াকিবহালদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তা হলো–
ক। ইউক্রেনকে বর্তমান যুদ্ধে রাশিয়ার দখলে যাওয়া বিশাল ভূখণ্ড সহ ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়ার উপর দাবী তুলে নিতে হবে বা ভুলে যেতে হবে। খ। ইউক্রেনকে ন্যাটো ভুক্তির যেকোনও প্রচেষ্টা থেকে বিরত বা ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি নিষিদ্ধ করা হবে। গ। ইউক্রেনে ইউরোপিয় কোন সৈন্য নিয়োজিত থাকতে পারবে না। ঘ। ইউক্রেন পারমাণবিক শক্তিধর হতে পারবে না।
এসবের বাইরে ১৮ আগস্ট ২০২৫ হোয়াইট হাউজে ইউরোপিয় নেতাদের সাথে বৈঠকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা বিষয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন এটি প্রথমত ইউরোপিয়দের দিক থেকে আসতে হবে অতপর আমেরিকা তাতে সম্পৃক্ত হবে। প্রসঙ্গক্রমে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট স্পষ্টতই উল্লেখ করেন কোন অবস্থাতেই আমেরিকান সৈন্য ইউক্রেনের মাটিতে পা রাখবে না।
১৮ আগস্ট ২০২৫ হোয়াইট হাউজে ইউরোপিয় নেতাদের সাথে বৈঠকের ফাঁকে ট্্রাম প্রায় ৪০ মিনিট প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে শলা পরামর্শ করেন। সে আলোচনায় আমি নিশ্চিত যুদ্ধ বিরতির বিষয়টি একবারও উঠেনি ফলশ্রুতিতে আলস্কা বৈঠককালীন যেমন তেমনি ১৮ আগস্ট ২০২৫ হোয়াইট হাউজে আলোচনাকালীন সময়েও রাশিয়া ইউক্রেনের উপর তার আক্রমণ পরিচালনা এবং নতুন নতুন ভূমি দখলে বিরত থাকেনি। আশ্চর্যের বিষয় হল ইউরোপিয় নেতারাও একদিকে শান্তি নিরাপত্তার কথা তুললেও অন্যদিক অস্ত্র সংগ্রহে ইউক্রেনকে অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে সে অর্থে হোয়াইট হাউজে বৈঠক চলাকালীন ইউক্রেন আমেরিকার কাছ থেকে ১০ (দশ) বিলিয়ন তথা দশ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কেনার প্রস্তাবও দিয়েছে। সম্ভবত এটি ইউরোপিয় নেতাদের ট্রাম্পকে বশে আনার একটি সম্মিলিত প্রয়াস হতে পারে। তবে এটি শান্তি উদ্যোগ এবং যুদ্ধবিরতি আকাঙ্ক্ষার সাথে একটি সাংঘর্ষিক আলামত। ইউরোপিয় নেতাদের এ দ্বি–চারিতা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভালোভাবেই অনুধাবনে সক্ষম এবিষয়টি নিশ্চিত। আর একারণেই পুতিন রাশিয়ার দিক থেকে ইউরোপকে এক ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মনস্ত্তাত্বিক চাপে রেখেছেন। মনস্ত্তাত্বিক এই চাপের ফল ১৮ আগস্ট ২০২৫ হোয়াইট হাউজে ন্যাটোর মহাসচীব, জার্মান চ্যান্সেলর, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী, ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপিয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সহ সবার ওয়াশিংটন যাত্রা এবং ট্রামের দ্বারস্থ হওয়া। নিরাপত্তা ঝুঁকির মনস্ত্তাত্বিক চাপ এবং কূটনৈতিক এই চালে পুতিন নিজেকে অনন্য এক অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন এটি অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।
ইউরোপ আমেরিকার উপর পুতিনের এই মনস্ত্তাত্বিক চাপই হয়ত বিশ্ব–শান্তির একটি বাতাবরণ উন্মোচন করতে পারে।
কারণ নিরাপত্তা ঝুঁকির মনস্ত্তাত্বিক এই চাপ না থাকাতে আমেরিকা ইউরোপের এই সম্মিলিত অপশক্তি গাজায় অবিরাম গণহত্যায় নির্বিকার ইসরাইলকে অর্থনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক সমস্ত প্রকার সহায়তা প্রদান করে এসেছে এবং অনুশোচনা বিহীনভাবে করে যাচ্ছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।