সমকালের দর্পণ

ইকোনমি অব জেনোসাইড - গণহত্যার অর্থনীতি -২

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৩ আগস্ট, ২০২৫ at ৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ

এটি পৃথিবীর সভ্যতা এবং সভ্য মানুষের জন্য এক চরম দুর্ভাগ্য যে এর পাদপীঠে দাঁড়িয়ে ইসরাইল নামক একটি রাষ্ট্র বছরের পর বছর ফিলিস্তিন নামক এক ভূখণ্ডে মানুষের প্রতি চরম নির্মমতা প্রদর্শন করে চলেছে।

এরই ফলশ্রুতি ২য় ইন্তেফাদা। এটি শুরু হয় ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০০ এবং শেষ হয় ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৫। প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, জাগরণ, আন্দোলন ইত্যাদির মিলিত এই ইন্তেফাদা শুধু ইসরাইল আর আরব উপদ্বীপকে নয় সমস্ত বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল প্রবলভাবে। অত্যাচার নিপীড়ন, নির্মমতার বিরুদ্ধে মানুষের এই প্রতিবাদী উত্থান ইসরাইল কঠোরভাবে দমন করে, অবশেষে ‘সরম আল শেখ’ এর আলোচনা বৈঠকের মাধ্যমে ২য় ইন্তেফাদা’র পরিসমাপ্তি ঘটে। ইন্তেফাদার সমাপ্তি হলেও ইসরাইল দ্বারা ফিলিস্তিনিদের উপর নিপীড়ন নির্যাতন, বাস্ত্তুচ্যুতি, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড কোনটি বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে বহুগুণ। এখন এটি ভাবতেও কষ্ট হয় এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ মানুষের গাজা নামক জনপদের উপর ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে চলেছে। এ বোমা বর্ষণের গত এক বছরের ওজন ৮৫,০০,০০০ (পঁচাশি হাজার) মেট্রিক টনেরও বেশি। অথচ সভ্য মানুষ অসভ্যতার, বর্বরতার কবলে পড়ে গাজায় অভুক্ত মানুষের জন্য অত খাবার বহন করে নিয়ে যায়নি ভালোবাসায়, মমতায়। মানুষ মানুষকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, চলাচলের স্বাধীনতাহীন মানুষকে ভেড়ার পালের মত ঘোরানো হচ্ছে যেখানে খুশি সেখানে। মানুষ মানুষের জন্য খাদ্যাভাব সৃষ্টি করে মানুষকে খাদ্যের জিম্মি করে রেখেছে। মানুষ মানুষকে আলো বঞ্চিত করে অন্ধকারে ক্রমাগত বন্দী করে রেখেছে। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করে মানুষকে শিক্ষাচিকিৎসা বঞ্চিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা রত মানুষ।

খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে খাদ্যের লাইনে দাঁড় করিয়ে বয়স নির্বিশেষে গুলি করে মারছে মানুষ। এটার নাম ‘Weaponzing hunger’ ‘খাদ্য হত্যার হাতিয়ার’। মানুষ কী হতভাগ্য। পানযোগ্য পানির সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে মানুষ মানুষকে পিপাসায় কাতর করছে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে গণহত্যার শিকার হাজারো মানুষ নাম পরিচয়হীন গণকবরে অনাদরে শায়িত হচ্ছে। এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ মানুষকে পুরুষানুক্রিমক বসতি থেকে উচ্ছেদ করে উদ্ভাস্ত্তু করছে। অভূক্ত অপুষ্টিতে শিশুরা মরছে মায়ের কোলে, মায়েরা জন্ম দিচ্ছে নিষ্পাপ শিশু যেন মৃত্যুর জন্য। ইসরাইলের পক্ষে এই নির্মমতা, এই আলোহীনতা, এই দুর্ভিক্ষ পীড়ন, এতসব বিভৎস হত্যাযজ্ঞ, এত হৃদয়হীন মৃত্যুর মিছিল আয়োজন সম্ভব হয়েছে। ফ্‌্রান্সেসকা আলব্যানেজ’ এর মতে কপোর্রেট এনটিটি তথা বহু জাতিক সংস্থাগুলির পুঁিজবাদী মানসিকতার উদগ্র লালসা এবং ফলশ্রুতিতে ইসরাইলকে অসংকোচ সমর্থন।

এ সমর্থনে যে সমস্ত বহুজাতিক সংস্থা কাজ করে তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মকাণ্ড আলব্যানেজ’ স্পষ্ট তুলে ধরেছেন। আলোচিত সে সমস্ত বহুজাতিক সংস্থাগুলির বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মকাণ্ড পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরছি।

ইসরাইল আমেরিকার বাইরে প্রথম দেশ যারা ২০১৮ সালে এফ৩৫ যুদ্ধ বিমান আকাশে উড়িয়েছে ফিলিস্তিনিদের হত্যার উদ্দেশ্যে। ইরানের বিরুদ্ধেও এই এফ৩৫ যুদ্ধ বিমান আকাশে উড়েছে। আমেরিকান কোম্পানী ‘লকহীড মার্টিন’ এ যুদ্ধ বিমানের নির্মাতা। এফ৩৫ যুদ্ধ বিমান ১৮০০০ (আঠার হাজার) পাউন্ড পর্যন্ত গোলাবারুদ নিয়ে লক্ষ্যবস্ত্তুতে নির্ভুল আঘাত হানতে অব্যর্থ। এ যুদ্ধবিমান পাওয়াতে ইসরাইল সর্ব্বক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই এফ৩৫ এবং এফ১৬ যুদ্ধবিমান গত এক বছরে গাজায় ৮৫,০০,০০০ (পঁচাশি হাজার) মেট্রিক টনেরও বেশি বোমা বর্ষণের মাধ্যমে ১৭৯,৪১১ (এক লক্ষ ঊনাশি হাজার চারশত এগার) জন ফিলিস্তিনিকে মারাত্মক আহত এবং হত্যা করেছে।

জাপানিজ কোম্পানী ‘এফ এ এন ইউ সি’ ইসরাইলকে রবোটিক যন্ত্রপাতি সরবরাহের মাধ্যমে তার সমরাস্ত্র উৎপাদনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে চলেছে। ২০২২২৩ অর্থ বছরে তারা যুদ্ধব্যয় বাড়িয়েছে ৬৫%। মোট অর্থের পরিমাণে যা দাঁড়িয়েছে ৪৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্বনামধন্য অস্ত্র উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি এই অর্থে নিজেদের মুনাফা আয় করে নিচ্ছে।

বিশ্বখ্যাত আই বি এম সেই ১৯৭২ থেকে ইসরাইলী সামরিক বাহিনীকে বিশেষ করে তার গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। আই বি এম’এর সহায়তায় ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক্স সহ যাবতীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে রেখেছে, যা ফিলিস্তিনিদের নানা উদ্দেশ্যে সনাক্তকরণ, উচ্ছেদ কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে আসছে।

মাইক্রোসফট আরেক বিশ্বখ্যাত কম্পিউটার কোম্পানী, ১৯৯১ সাল থেকে ইসরাইলে তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। আমেরিকার বাইরে মাইক্রোসফট’এর সবচেয়ে বড় স্থাপনা ইসরাইলে। মাইক্রোসফট ইসরাইলী সেনাবাহিনীকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যাবতীয় গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনায় সক্রিয় সহযোগিতা করে চলেছে। এর মাঝে কারা অভ্যন্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল কলেজ এবং বিভিন্ন উদ্বাস্ত্তু শিবিরে গোয়েন্দা তৎপরতা অন্যতম।

গগুল তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণে তার ‘ক্লাউড’ স্টোরেজ ব্যবহার করার নিমিত্তে ইসরালী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে ইতিমধ্যে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

লেবেন্ডার’ ‘গসপেল’ এবং ‘হোয়ার ইজ ড্যাডি’ ইত্যাদি এপস গুলির মাধ্যমে ‘প্লান্টির টেকনোলজি’ আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্ট তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে সহায়তা করে ইসরাইলকে আধুনিক যুদ্ধ ক্ষেত্রে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যায় সাহয্যের হাত বাড়িয়েছে।

ক্যাটারপিলার’ স্বনাম ধন্য যন্ত্রপাতি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এই ‘ক্যাটারপিলার’ আমেরিকান বৈদেশিক সামরিক বাহিনীকে সহায়তা প্রকল্পের আওতায় ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ, ঘরবাড়ি ধ্বংসকরণে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে আসছে। এর মাঝে ফিলিস্তিনিদের বাগান, শস্যক্ষেত্র, চলাচলের পথ, মসজিদ, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিছুই বাদ যায়নি। ‘ক্যাটারপিলার’ তার অটোম্যাটেড বুলডজারের মাধ্যমে ঝুঁকিবীহিনভাবে ইসরাইলী সামরিক বাহিনীকে ফিলিস্তিনিদের যাবতীয় স্থাপনা ধ্বংসে মদদ দিয়ে যাচ্ছে।

কোরিয়ার বিখ্যাত ‘হুন্দাই’ সুইডেনের ‘ভলবো’ কোম্পানীর সাথে মিলিতভাবে তাদের ভারী যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছে। সেখানে এমনকি ফিলিস্তিনিদের অলিভের বাগান সমূহও এই অমানবিক হৃদয়হীন কর্মকান্ড থেকে রক্ষা পায়নি। ‘হুন্দাই’ ‘ভলবো’র ভারী যন্ত্রপাতি গাজা’র বাড়িঘর ভাঙার তাণ্ডবেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে।

ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদপূর্বক তাদের ভিটেবাড়িতে ইসরাইলীরা এ পর্যন্ত ৪০০ (চারশত)’র ও অধিক বসতী গড়ে তুলেছে। এসব বসতি স্থাপনের নিমিত্তে উচ্ছেদে এবং নির্মাণে ‘হুন্দাই’ ‘ভলবো’ এবং ‘ক্যাটারপিলার’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০২৪ এর অক্টোবর থেকেই ইসরাইল এসব কোম্পানীর সহায়তায় ৫৭ (সাতান্ন) টি নতুন বসতি নির্মাণে হাত দিয়েছে। স্প্যানিশ কোম্পানি ‘স্প্যানিশ বাস্ক কনস্ট্রাকশন’ ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূমিতে ইসরাইলের বসতি সমূহে রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

কেলার উইলিয়ামস’ বিশ্বব্যাপী রিয়েলস্ট্যাট ব্যবসায় জড়িত। এই ‘কেলার উইলিয়ামস’ ‘কে ডাবলিউ’ ইসরাইল’ এর সাথে মিলিতভাবে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদপূর্বক ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে সেখানে ‘হোম ইন ইসরাইল’ প্রচারণার নিমিত্তে আমেরিকা এবং কানাডায় রোড শো’র আয়োজনও করে।

বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের মুনাফা অর্জনে অধিকৃত ফিলিস্তিনে পানিকেও দুঃষ্প্রাপ্য পণ্য করেছে। ‘মেকরর’ নামক কোম্পানি গাজায় পানির পাইপ লাইন স্থাপন করে পানির উপর একক কর্তত্বের মাধ্যমে মুনাফা লুটছে। ইসরাইলীরা এখানে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত, এজন্য ফিলিস্তিনিরা নানাবিধ শোষণের মাধ্যমে আর্থিকভাবে যতই দুর্বল হবে ততই তাদের ইপ্সিত লক্ষ্য পূরণ হবে।

বহুজাতিক সংস্থাগুলির ‘ফ্রম ইকোনমি অব অকুপেশন টু ইকোনমি অব জেনোসাইড’ এর সবচেয়ে বেদনাদায়ক এবং কদর্য দিক হল ফিলিস্তিনিদের যাতায়াতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে তাদের বাধ্যতামূলক শ্রম দানের মাধ্যমে নায্য মজুরি থেকে বঞ্চিতকরণ। ফ্‌্রান্সেসকা আলব্যানেজ এ বিষয়গুলি ব্যাপক বিস্তৃত এবং গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরেছেন। ফলশ্রুতি ফ্‌্রান্সেসকা আলব্যানেজ’কে আমেরিকা ১০ জুলাই ২০২৫ সে দেশে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্লাস্টিক ও জলাবদ্ধতা
পরবর্তী নিবন্ধরাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখবে ভারত