সমকালের দর্পণ

মেজর মোহম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ইরান দক্ষিণ পশ্চিম এশিয় একটি দেশ। এর আয়তন ৬৩৬,৩৭২ (ছয় লক্ষ ছত্রিশ হাজার তিনশত বাহাত্তর) বর্গ মাইল। আয়তনের দিক থেকে ইরান পৃথিবীর সতেরতম বৃহৎ দেশ। ইরানের উত্তরে রয়েছে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং কাস্পিয়ান সাগর। উত্তর পশ্চিমে তুর্কমেনিস্তান। পশ্চিমে তুরস্ক এবং ইরাক। দক্ষিণে পার্সিয়ান এবং ওমান উপসাগর। পূর্বে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান।

জনসংখ্যা ৮ কোটি ৮০ লক্ষ। এর মাঝে যুদ্ধে যেতে সক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। ইরানের বর্তমান সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১০ লক্ষ ১৮ হাজার। এর মধ্যে ইরানী রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার এবং রিজার্ভ ৩ লক্ষ ৫০ হাজার।

বর্ণিত উপরোক্ত সামরিক সদস্যদের বাইরেও ইরানের রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের নানা প্রান্তে প্রক্সি তথা অনুগত যোদ্ধার দল। এর মাঝে ইয়েমেনে হুতি, ইরাক সিরিয়ায় মিলিশিয়া বাহিনী, লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনে হামাস’এর মত সংগঠন সমূহ। সৈন্য অস্ত্রবল আর সক্ষমতার দিক থেকে পৃথিবীর ১৪৫ টি দেশকে নিয়ে যে অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে তার মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৫ তম, যা ইসরাইল এবং সৌদি আরবেরও উপরে।

অতীতে ইরান পারস্য নামেই আখ্যায়িত ছিল। পারস্য সাম্‌্রাজ্যের সেই সময় ব্যাপক প্রভাব আর বিস্তৃতি ছিল। মূলত এশিয়ার প্রাণকেন্দ্র সেই সদূর অতীত থেকে তিনটি অবিধায় বিভক্ত ছিল। যা অটোম্যান তথা তুর্কি, মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব এবং পারস্য তথা ইরান হিসাবে পরিচিত ছিল।

এই তিন অঞ্চলকে নিয়ে শত বছর ধরে বৃটিশ এবং ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীরা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। এ ষড়যন্ত্রের মূল কারণ মধ্যেপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার এবং সেই সূত্রে এ অঞ্চলের তেল সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন। এক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের উপর অটোম্যানদের প্রশ্নাতীত আধিপত্য ছিল। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের সূত্রে অটোম্যানরা সে আধিপত্য হারায়।

বৃটিশ এবং ফরাসীরা অটোম্যানদের হারানো জায়গা দখল করে নেয়। বৃটিশরা মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও তাদের লুটেরা হাত বাড়ায়। ইরান এর থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট ইরানের উপর বৃটিশ -আমেরিকান নগ্ন হস্তক্ষেপ।

ঘটনার সূত্রপাত। ১৯৫১ সালে রাজনীতিবিদ, লেখক, আইনজীবী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক বিপুল ভোটে ইরানের ৩০ তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। র্ন্বিাচিত হয়ে মোসাদ্দেক তার দেশের তেল সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দেখেন তার দেশের তেল বিক্রয় লব্ধ মুনাফার মাত্র ১০% তার দেশ পায় বাকী পুরাটাই বৃটিশদের। তিনি যৌক্তিক মুনাফা ভাগাভাগির দাবী করলে বৃটিশরা তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। মোসাদ্দেক তার দেশের তেল ক্ষেত্র সমূহ জাতীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

প্রতিক্রিয়ায় বৃটিশরা ‘অপারেশন বুট’ নাম দিয়ে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুতির গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে। অল্প দিনের মধ্যে ‘অপারেশন আজাক্স’ নাম দিয়ে আমেরিকান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুতির ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়। ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ এবং বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম সিক্স তেহরানের পথে পথে দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়।

ইরানি সেনাবাহিনী মোসাদ্দেকের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর জেনারেল ফজলুল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করেন। মোসাদ্দেককে বিচারের মুখামুখি করা হয়। স্বীয় দেশের স্বার্থ রক্ষার দোষে দোষি মোসাদ্দেকের তিন বছর কারাদণ্ড এবং বাকী জীবন গৃহ বন্দীত্ব বরণ করে জীবনের যবনিকাপাত ঘটাতে হয়, মোসাদ্দেকের অদৃষ্টের এমনই পরিহাস।

পরবর্তীতে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের আর লিবিয়ার মোয়াম্মার গাদ্দাফীর নির্মম ক্ষমতাচ্যুতির মাধ্যমে। বাকী ছিলেন সিরিয়ার বাশার আল আসাদ। নানা ষড়যন্ত্র, সংঘাত আর সংঘর্ষে জর্জরিত সিরিয়ায় শান্তি স্থাপনে ২০১১ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচীব বানকি মুন তার পূর্বসূরি কফি আনানকে নিয়োগ দেন সিরিয়ায় শান্তি স্থাপনে। কফি আনান তার আন্তরিক এবং কুশলী প্রচেষ্ঠায় সকল পক্ষকে শান্তি স্থাপনে সম্মত করে যখন তা চূড়ান্ত করে সম্মত স্বাক্ষর আয়োজনে ব্যস্ত তখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শর্ত জুড়ে দেন, যে কোন শান্তি স্থাপনের পূর্ব শর্ত হতে হবে বাশার আল আসাদের পদত্যাগ। এ শর্তের কথা জেনে কফি আনান তার উপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। সিরিয়ায় শান্তি আসেনি। শ্যারন আর উইনন এই দুই ইসরাইলী কৌশল প্রণেতার প্রণীত কৌশল অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলিতে কোন শক্তিশালী সরকার থাকবে না আর গোত্রে গোত্রে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ক্রমাগত সংঘাত সংর্ঘষ তথা পার্মান্যান্ট ওয়ার বা অবিরাম যুদ্ধাবস্থা বজায় রাখতে হবে। সেই থেকে ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ সিরিয় প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের ক্ষমতাচ্যুতি পর্যন্ত সিরিয়ায় তাই করা হয়েছে।

আমাদের মজার বাংলা ছড়া ‘হারাধনের ছেলেদের’ মত বাকী থাকে ইরান!

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ ‘এক্সিস অব এভিল’ নাম দিয়ে ইরাক আর উত্তর কোরিয়ার সাথে ইরানকেও একই ব্র্যাকেটে আবদ্ধ করে। বুশ ‘ডের্জাট স্ট্রম’ বা মরু ঝড় নাম দিয়ে ইরাকে অভিযান পরিচালনার পরপর ইরানেও অভিযান পরিচালনার পায়তারা এঁটেছিলেন। এর পিছনে ইন্ধন ছিল ইসরাইল এবং ওয়াশিংটন ডিসি তথা ক্যাপিটাল হিলস’এর নিওকন’দের, এই নিওকনরা উগ্র ইসরাইল পন্থী। দুটি কারণে জর্জ বুশের সেই সময়ের ইরান আক্রমণ হালে পানি পায়নি। প্রথমত ইরাক অভিযান মিথ্যার উপর পরিচালিত হয়েছিল, ইরাকে গণ বিধ্বংসী কোনো অস্ত্র পাওয়া না যাওয়া এর ফলে সাধারণ আমেরিকানদের মাঝে ইরাক যুদ্ধের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি। দ্বিতীয়ত ১৬ টি আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে গঠিত ‘এন আই ই’ বা ‘ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্ট এস্টিমেট’ এর ইরানের উপর উপস্থাপিত সম্মিলিত এক প্রতিবেদন। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়

‘এটি নিঃশ্চিত, ইরান তার পারমানবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি স্থগিত রেখেছে।

২০০৭ সালে এসেও দেখা গেছে ইরান তার পারমানবিক কর্মসূচি পুনঃরাম্ভ করেনি।

ইরানের কাছে কোন পারমানবিক অস্ত্র নাই। এমতাবস্থায় ইরান চাইলেও তার বর্তমান সক্ষমতা এবং প্রকৌশলগত অবস্থান থেকে ২০১৫ সালের আগে তার পক্ষে কোন পারমানবিক অস্ত্র তৈরি সম্ভব নয়।

‘ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্ট এস্টিমেট’ এর অভিমত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রভাব এবং চাপে ইরান তার পারমানবিক অস্ত্র তৈরী থেকে বিরত রয়েছে।

‘ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্ট এস্টিমেট’ তাদের প্রতিবেদনের উপসংহারে আসেন এইভাবে combination of threats of intensified international scrutiny and pressure along with opportunities for Iran to achieve its security, prestige and goals for regional influence in other way could encourage Iran to continue the halt in weapons development. মোদ্দা কথা ইরানকে আর্ন্তজাতিক চাপ, কঠোর পর্যবেক্ষণের কথা স্মরণ করানোর পাশাপাশি তার নিরাপত্তা, সম্মান এবং কাঙ্ক্ষিত আঞ্চলিক আধিপত্য অর্জনে অন্যবিদ পন্থা অবলম্বনের পথ উন্মুক্ত রাখলে ইরান তার পারমানবিক কর্মসূচী স্থগিত রাখার বিষয়টি বজায় রাখতে পারে।

ইসরাইলী লক্ষ্য ইরাকের পর ইরান আক্রমণ এভাবেই সে সময় ভেস্তে যায়। কিন্ত্তু ইরান ইসরাইল বা আমেরিকা কেউ শান্তির পথে তেমন ভাবে আগায়নি। ইরান তার প্রক্সি হিজবুল্লাহ, হামাস, হুথি, ইরাক – সিরিয়ার বিদ্রোহী মিলিশিয়া’দের নিয়ে যেমন স্বীয় প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে ইসরাইলের জন্য ক্রমাগত হুমকির সৃষ্টি করেছে, তেমনি ইসরাইল একের পর এক হামাস হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত করে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হামাসের প্রতিষ্ঠাতা হুইল চেয়ারে চলাচলরত শেখ মোহাম্মদ ইয়াসিন, হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া, হামাসের সামরিক বাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া সিনাওয়াত্রা। একইভাবে ইসরাইল ১৯৯২ সালে হিজবুল্লাহ প্রধান মুসাভিকে এবং ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ হাসান নাসরুল্লাহকেও হত্যা করে। অন্যদিকে ৩ জানুয়ারী ২০২০ সালে আমেরিকা বাগদাদে এক ড্রোন হামলার মাধ্যমে ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলাইমানীকে হত্যা করে। ঘটানার মারাত্মক মোড় নেয় যখন ১ এপ্রিল ২০২৪ ইসরাইল দামেস্কস্থ ইরানী কনস্যুলেট আক্রমণ করে সাত ইরানী কমাণ্ডারকে হত্যা করে। ইরানী প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় থেকে পৃথিবীর মানুষ দেখে ১৩/১৪ এপ্রিল ২০২৪ ইরান প্রায় ৩০০ ক্ষেপনাস্ত্র, ড্রোন আর ব্যালেস্টিক মিসাইলের মাধ্যমে ইসরাইলের উপর আঘাত হানতে।

হামলা পাল্টা হামলার এই ডামাডোলে ডোনাল্ট ট্রাম আমেরিকার ক্ষমতার দৃশ্যপটে পুনঃরায় অধিষ্ঠিত হন। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে ট্রাম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথেষ্ট সমীহ আদায় করলেও গাজায় ক্রমাগত সংগঠিত গণহত্যার ব্যাপারে তার নির্লিপ্ততা, গণহত্যাকারী ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন এবং গাজাবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে গাজা দখলের ঘোষণা বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের হতভম্ব এবং স্তম্বিত করে। এর পিছনের মূল কারণ খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। কারণ গাজার মরণ জয়ী যোদ্ধারা ইরানের মদদপুষ্ট। ইসরাইল আমেরিকার ভয় এ যুদ্ধে হামাস জয়ী হলে তা হবে ইরানের জয়। এতদঅঞ্চলে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি পেলে তা ইসরাইলের আধিপত্যের জন্য যেমন হুমকি তৈরী করবে তেমনি তা আমেরিকার অবাধ তেল প্রবাহেও বিঘ্ন ঘটাবে। ইরানকে নিয়ে ইসরাইল আমেরিকার ভয়টা ঠিক এই জায়গায়।

স্কট রিটার,আমেরিকার মেরিন কোরের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্নেল, যিনি ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে আনীত গণ বিধ্বংসী অস্ত্র মওজুদের অভিযোগ প্রমাণে পরিচালিত জাতিসংঘের তদন্ত দলের প্রধান অস্ত্র পরিদর্শক ছিলেন। স্কট রিটার তার প্রতিবেদনে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন ইরাকে কোন গণ বিধ্বংসী অস্ত্রের মওজুদ নাই। তারপরও আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ইরাক আক্রমণ করে, লক্ষ্য ছিল সাদ্দাম হোসেন গণ বিধ্বংসী অস্ত্র নয়। এই যুদ্ধে ইরাকের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়, দুর্ভাগ্য সেই যুদ্ধে আমরাও অংশগ্রহণ করেছিলাম।

স্কট রিটার সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন, নাম ‘হাইওয়ে টু হেল’। রিটার দুঃখ করে বলেছেন, ‘আওয়ার স্টেট এন্ড ডিফেন্স ডির্পাটমেন্ট আর হাইজ্যাক বাই দি জিওনিস্ট’। অর্থাৎ আমাদের পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইহুদিবাদীরা হাইজ্যাক করেছে। পৃথিবীর বিবেকবান মানুষদের ভয় এই জায়গায় আমেরিকার কাঁধে চড়ে জায়নবাদীরা কখন কী করে বসে। (চলবে)

লেখক: কথাসাহিত্যিক, সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসহায় পরিবারগুলোর দায়িত্ব নিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে