সমকালের দর্পণ

সমাজ আর রাষ্ট্রের জন্য সামাজিক শিষ্টাচার এবং দূরদর্শিতা অপরিহার্য

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২১ পূর্বাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে শিরোনামে উল্লেখিত দুটি বিষয়ে চরম ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি উদ্বেগের এবং নিঃসন্দেহে জাতির জন্য শঙ্কার।

প্রথমেই আসি সামাজিক শিষ্টাচারের বিষয়ে। সামাজিক শিষ্টাচার একটি সুস্থ সমাজের জন্য শুধু কাম্যই নয় একান্ত জরুরিও বটে। সামাজিক শিষ্টাচারের অবক্ষয় হলে সমাজ তার গাঁথুনি শক্তি হারায় এবং সমাজে অনাচার অরাজকতা প্রশ্রয় পায়।

অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চট্টগ্রামের একটি ঘটনার উল্লেখ করছি তা হলে পাঠক বুঝতে পারবেন আমাদের সামাজিক সম্প্রীতি তথা শিষ্টাচার কোন অতলে গিয়ে ঠেকছে। বিয়ের অনুষ্ঠান দুটি সচ্ছল পরিবারের। অনুষ্ঠানস্থল নেভী কনভেনশন সেন্টার। এটি এখন চট্টগ্রাম শহরে বড় অনুষ্ঠানের জন্য অন্যতম ভেন্যু। হাজার হাজার অতিথির সমাগম। এর মাঝে নারী পুরুষ বৃদ্ধ বৃদ্ধা, যুবক যুবতী শিশুরা সামিল। অতিথি আপ্যায়ন চলছে। অতিথিদের আসা যাওয়া চলছে। ট্রাফিক পুলিশদের গাড়িঘোড়া নিয়ন্ত্রণে বেশ তৎপর দেখা গেছে। এসব আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আমন্ত্রিত হয়ে আমিও সেই অনষ্ঠানে গিয়েছি। অন্য অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য দেরী না করে আমন্ত্রণকারীদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে বেরিয়ে পড়ি।

নেভি কনভেনশন সেন্টারের অনতিদূরে জিইসি কনভেনশন সেন্টারে পৌঁছে শুনি নেভি কনভেনশন সেন্টারের বিয়ের অনুষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। পরর্বতীতে নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পারি আক্রমণকারীরা কোন একজন সাংসদের গাড়ি অনুষ্ঠানস্থলে যেতে দেখেছে এবং উনার খোঁজে এই আক্রমণ।

কথিত সেই সাংসদকে পাওয়া যায়নি। পরর্বতীতে বরের বাবাকে অনুষ্ঠানস্থল থেকে তুলে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। ব্যাপারটা আমার কাছে কষ্টের এবং বেদনারও বটে। কারণ ব্যতিক্রম ছাড়া ছেলে মেয়েরা একবারই বিয়ে করে। ছেলেটি বা মেয়েটি যখন দেখে তাদের সেই স্মরণীয় শুভ অনুষ্ঠানটি থেকে তার বাবাকে আদালতের কোনো পরোয়ানা ছাড়া একদল লোক জোর করে তুলে নিয়ে পুলিশে সোপর্দ করছে, তখন তাদের মনোজাগতিক অবস্থা কেমন হবে পাঠকরা একবার ভাবুন!

বিষয়টি এমনও তো হতে পারত যাকে তুলে পুলিশে সোপর্দ করা হল সে যদি অপরাধীও হয় তাহলে সেটি পুলিশকে জানানো যেত, পুলিশের গোয়েন্দারা তাকে চোখে চোখে রেখে অনুষ্ঠান শেষ হলে বর কনেকে বিদায় করে ঐ ভদ্রলোককে তুলে নিয়ে যেতে পারত। কৌতুহলের বিষয় হল যারা একটি বিয়ের অনুষ্ঠানস্থল থেকে একজন ভদ্রলোককে তুলে নিয়ে গেলেন তারা কোন আইনে একাজটি করলেন বা একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অনাচার সৃষ্টি করা হল তা আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী একবারও ঐ উচ্ছৃঙ্খল জনতার কাছে জানতে চায়নি বরং তাদের আস্কারা দিয়ে ধরে আনা ভদ্রলোককে একটি মামলায় আটক দেখিয়ে কোর্টে চালান করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় সামাজিক শিষ্টাচারের এবং দেশের বিদ্যমান আইনের কি পরিণতি হল তা পাঠকই বিচার করবেন।

দ্বিতীয় ঘটনা। বই মেলা। বই মেলাতে সচরাচর বই প্রেমিক তথা পাঠকরা ভিড় করেন পছন্দের বই সংগ্রহ করতে। ছাত্রছাত্রী সহ বিপুল সংখ্যক মননশীল মানুষ ফেব্রুয়ারি মাসের অপেক্ষায় থাকেন, উৎসুখ্যে থাকেন কী কী নতুন বই নতুন দিগন্তের হাতছানি দিয়ে তাদের সামনে হাজির হতে যাচ্ছে, ঐসব বইয়ের পাতায় পাতায় কী চমক তাদের মনোজগৎ এ উন্মোচিত হবে সে আশায়। এখানে কোনো রাজনীতি নেই, কোনো হানাহানি, কোনো দলাদলি নেই। বইমেলা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মনন মেধা বিকাশের বিশাল এক দিগন্ত। আমাদের দূরদর্শী সৃষ্টিশীল মানুষেরা বইমেলা চালু করে আমাদের প্রজন্ম সমূহকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন নিঃসন্দেহে। সে বই মেলায় এবার একটি কুৎসিত এবং নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে, যা আমার বিশ্বাস আমার মত অনেকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ হয়েছে। বিষয়টি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে বইমেলার প্রবেশমুখে ডাস্টবিন স্থাপন। বইমেলা সর্বজনীন, রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য হাজারো প্লাটর্ফম রয়েছে। রাজনীতির অশিষ্টাচার দিয়ে বইমেলার সর্বজনীন পবিত্র অঙ্গনকে কলুষিত করার অধিকার কারো আছে বলে আমি মনে করি না। আমার বিশ্বাস মননশীল মানুষেরাও এটাকে ভালো ভাবে নেননি। এ অশিষ্টাচরের ফল কী হল? ত্বরিৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে দেখা যেতে লাগল আরো অরুচিকর অশ্রাব্য দৃশ্যের অবতারণা।

এই পাল্টপাল্টি একটি জাতির নতুন প্রজন্মকে কী দেখাল আর কী শিখাল?

তৃতীয় ঘটনা। ‘মব জাস্টিস’ বা ‘বুলডোজার কীর্তি’। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২৫ অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক ঘটা করে বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক দল সমন্বয়ে জাতীয় ঐকমত্য সভা আহবান করা হয়। এ সভার আগেই জাতিকে একধরনের অনৈক্যের গেঁড়াকলে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে আমার অভিমত। সে ঠেলে দেওয়ার নাম ‘বুলডোজার কীর্তি’ বা ‘মব জাস্টিস’।

জাতীয় ঐক্য এবং পুনর্মিলনের একটি উদাহরণ। সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াস্থ ন্যাশনাল আর্মি ওয়ার কলেজে শান্তিরক্ষীর অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য আমাকে বেশ কিছুদিন সে দেশে অবস্থান করতে হয়। এই সুযোগে সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদ উত্তর জাতীয় ঐক্য/পুনর্মিলনার্থে নেলসন ম্যান্ডেলা কতৃক যে ‘ট্রুথ এ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করা হয় তা বাস্তবে এবং নথিপত্রে দেখার এবং জানার আমার কিছুটা সুযোগ হয়। সেই কমিশনের মৌলিক কিছু বিষয় আমার পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি।

নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্ব গ্রহণ করে ১৯৯৫ সালে ‘ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ এর মাধ্যমে ‘ন্যাশনাল ইউনিটি এন্ড রিকনসিলিয়েশন এ্যাক্ট ৩৪ প্রর্বতন করেন।

ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ এর ব্যানারে ৫০ টির মত সংগঠন যাদের মধ্যে এ এন সি, ইনথেকাথা ফ্রিডম পার্টি এবং প্যান আফ্রিকানিস্ট ইত্যাদি রাজনৈতিক দলও অন্তর্ভুক্ত ছিল তারা প্রায় একবছর সময় নিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে টি আর সি বা ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিটি গঠন করে। গণ শুনানির মাধ্যমে এই কমিশনের ১৭ জন কমিশনার নিযুক্তি লাভ করেন। বিশপ ডেসমন্ট টুটুকে কমিশনের প্রধান করা হয়।

এই কমিশন ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত সংঘঠিত অপরাধের মাত্রা, প্রেক্ষাপট, বিষয় ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়। কমিশন যারা ঘটনার শিকার তাদের প্রাধান্য দিয়ে কাজ শুরু করে। অপরাধের শিকার এরকম ব্যক্তিদের কাছ থেকে কমিশন প্রায় ২২,০০০(বাইশ হাজার) অভিযোগ গ্রহণ করে। অভিযোগ সমূহের বিপরীতে মার্জনা বা অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার ৭০০০ (সাত হাজার) এর উপর দরখাস্তও কমিশন গ্রহণ করে। কমিশন মারাত্মক অপরাধ যেমন নির্যাতন, হত্যা, গুম ইত্যাদি বিষয়গুলির উপর গণশুনানি করে। এই গণশুনানির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে ঘটনাসমূহ অবহিত রাখা। কমিশন প্রায় ১৫০০ ( দেড় হাজার) ঘটনার হাজার হাজার অভিযুক্তকে মার্জনা প্রদান করেন। এই কমিশনের দুর্বল দিক ছিল কমিশন উচ্চ পদস্থ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল এবং সামরিক কর্মকর্তাদের কমিশনের সামনে আনতে সক্ষম হয়নি। এইসব ব্যক্তিদের যুক্তি ছিল তারা প্রদেয় দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র এবং এতে দোষের কিছু করেননি।

আন্তর্জাতিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকীয় ‘ট্রুথ এ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ ‘নুরেমবার্গ আদালত’ এর বিপরীতে জাতিগোষ্ঠী তথা মানুষে মানুষে বিভক্তি সৃষ্টির অভিঘাতকে গভীর না করে পুনর্মিলনের পথে ঐক্যমত্য সৃষ্টিতে এক যুগান্তকারী উদাহরণ সৃষ্টি করে। এখান থেকে আমাদেরও শিক্ষণীয় থাকতে পারে ভবিষ্যৎ পথ চলাতে।

বেশ অনেকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ বুলাতে গিয়ে কোনো এক অজানা অভিমানী ভাবুকের নিম্নের কথাগুলির প্রতি আমার চোখ থমকে ছিল। সেই লেখাটি এখানে তুলে ধরলাম।

চোখ বিক্রি করে আমি এই শহরে এসেছি। ক্ষমতাবান নেতামন্ত্রীদের নর্তন কুর্দন, উঁচু তর্জনি না দেখার জন্য। চারদিকে তাই তাদের দেখি না এখন। পথের মধ্যে একজন বলেছিল, কান দুইটিও রেখে যাও। রেখে টাকা নিয়ে চলে এলাম। এখন আমি আর নেতা মন্ত্রীদের অসার তর্জন গর্জন আর মিথ্যাচার কিছুই শুনি না।

তবে মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে এই শহরে। একজনকে বললাম এই খারাপ লাগার কারণ কী? তিনি বললেন বোকা কোথাকার, সব বিক্রি করেছ, বিবেকটা বিক্রি না করলে ত এমন খারাপ লাগবেই

এরপর এই শহরে আমি একজন ভাল ক্রেতা খুঁজে বেড়াচ্ছি। কয়েকজনকে পেয়ে বললাম, আমার একটা বিবেক আছে। খুব কম দামে বেচতে চাই। কেউ নেবেন ভাই? এরা সবাই একযোগে বলে উঠলেন, মাথা খারাপ! আমরা এই মাত্র নিজেদের বিবেক বেচে দিয়ে এলাম। এভাবেই আমরা সবাই এ পাথুরে নগরীতে গবেট হয়েই বেঁচে আছি’।

আজকের পর্ব শেষ করতে চাই এই কামনায়, উপরের এই লাইনটি যেন র্স্বাংশে মিথ্যা হয়। আমরা যেন জাগ্রত বিবেক নিয়ে প্রাণবন্ত এক শহরের বাসিন্দা হই।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে