শীতের চাদর জড়ানো এখন আমার এই শহর জুড়ে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের ধুম। এসব অনুষ্ঠানের যেখানেই গিয়েছি লসএনঞ্জেলেসের দাবানল নিয়ে সচেতন মানুষদের আলোচনায় মুখর হতে দেখেছি। তাদের সবারই মুখে প্রায় একটিই সুর একটিই প্রশ্ন আমেরিকার মত একটি পরাশক্তি প্রকৃতির কাছে এভাবে পরাভূত? আলোচনান্তে উপসংহারের মত একটিই বক্তব্য ‘পরাভূত হবেই না বা কেন? এটি আল্লাহ’র বিচার’ এভাবেই সচেতন বা আলোচকরা তাদের আলোচনার সমাপ্তি ঘটাতে দেখেছি।
আমার আস্তিক মননেও শিরোনামের বিষয়টি নিয়ে সময়ে প্রশ্ন জেগেছে, আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকেই আজকের এ আলোচনা।
আমেরিকা আবিষ্কৃত হবার পর ওল্ড ওয়ার্ল্ড আর নিউ ওয়ার্ল্ড এ দুটি অবিধায় বিভক্ত হয়ে আফ্রিকা তথা ওল্ড ওয়ার্ল্ড থেকে দলে দলে প্রকৃতির বুকে অবারিত ঘুরে বেড়ানো মানুষকে বন্দি করে নিউ ওয়ার্ল্ড তথা আমেরিকায় দাস হিসাবে পাচার করা হয়েছে। এ নির্মম ব্যবসা ইতিহাসে ‘আটলান্টিক শ্লেইভ ট্রেড’ হিসাবে বিখ্যাত হয়ে আছে। মানুষ পাচারের এই ঘৃণ্য ব্যবসায় শুধু আটলান্টিকের বুকে দেড় কোটি মানুষের সলীল সমাধি হয়েছে। মানুষের পাচার হওয়া, দাসত্ব প্রথার নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে ‘আংকেল টমস ক্যাবিন’ ‘ভিলাবিট’ আর ‘রুটস’ এর মত কালজয়ী উপন্যাস সমূহে। বর্ণবাদের বর্বরতায় আমেরিকার সাদা মানুষেরা কালো মানুষদের নিষ্পেষণ আর নিপীড়নের চরম সীমায় নিয়ে গেলে আমেরিকারই বিবেকবান মানুষেরা তার প্রতিবাদে প্রতিকারে নেমে পড়ে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি এ নিয়ে আমেরিকায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ইউনিয়নিস্ট আর কনফেডারেট এ দু দলে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধমান আমেরিকানরা এক নির্মম হন্তারক সময় পাড় করে। এ গৃহ যুদ্ধে উভয় পক্ষ মিলে ৬ লক্ষ ২০ হাজার আমেরিকান সৈন্যের মৃত্যু ঘটে।
ইতিহাসের পরবর্তী পথযাত্রায় দেখা যায় আমেরিকানরা ইতিহাসের এই সব নির্মমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কোন পাঠ গ্রহণ করেনি।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৫ শত ১৬ জন আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ৪ লক্ষ ৫ হাজার ৩ শত ৯৯ জন আমেরিকান সৈন্য প্রাণ হারায়। জার্মানীকে বিভক্তি করণের মাধ্যমে পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানী সৃষ্টি। জার্মানদের সীমাহীন দুর্ভোগের কারণ এ যুদ্ধ।
এসব হন্তারক সময় এবং স্বজন হারানো থেকেও আমেরিকানরা কোনো পাঠ গ্রহণ করেনি। পাঠ গ্রহণ না করার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিরোশিমা – নাগাসাকি’তে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধের ইতিহাসে আমেরিকানদের নিরীহ মানুষ হত্যার কলংকজনক অধ্যায় রচনা করা। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট যে যুদ্ধ বিমানের মাধ্যমে হিরোশিমায় পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার পাইলট ছিলেন মেজর পল টিবেট। পারমানবিক এই বোমার ডিজাইন করেছিলেন রবার্ট ওপেন হাইমার। হিরোশিমায় নাগাসাকি’তে পারমানবিক বোমার ধ্বংস লীলা দেখে উৎফুল্ল ওপেন হাইমার নাকি আপসোস করেছিলেন সে কেন আরো আগে এ বোমা তৈরী করেনি, তাহলে তা জার্মানদের বিরুদ্ধে ও ব্যবহার করা যেত। দুঃখ বা বেদনার্ত হওয়া তো নয়ই।
২৫ জুন ১৯৫০ – ২৭ জুলাই ১৯৫৩ পর্যন্ত চলা কোরিয় যুদ্ধ কোরিয়াকে বিভক্ত করে। এ যুদ্ধে ৩০ লক্ষ কোরিয় জীবনের করুণ সমাপ্তি ঘটে, ৩৬ হাজার ৫০০ শত আমেরিকান সৈন্যের জীবন নির্বাপিত হয়। এ যুদ্ধের পরিণতি এখনও কোরিয় জাতিগোষ্ঠীর বিভক্ত থাকার মাধ্যমে দুর্ভোগ দুর্দশায় নিপতিত থাকা।
ভিয়েৎনাম যুদ্ধ। ১ নভেম্বর ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ এর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধের খতিয়ান ৩০ লক্ষ ভিয়েৎনামী, ৩ লক্ষ ১০ হাজার কম্বোডিয়, ৬২ হাজা লাওসীয় এবং ৫৮ হাজার ২ শত ২০ জন আমেরিকান সৈন্যের জীবন অবসান।
আফগানিস্তান – ইরাক যুদ্ধ। ১ অক্টোবর ২০০১ থেকে ৩০ আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত চলা আফগান যুদ্ধে আমেরিকান ২ হাজার ৪ শত ৫৯ জন সৈন্য নিহত হয়। বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী ২০ মার্চ ২০০৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত চলা ইরাক অফগান যুদ্ধে ৪৫ লক্ষ সামরিক বেসামরিক আফগান– ইরাকি প্রাণ হারান। আমেরিকা এ হত্যাকাণ্ড চালায় ‘ওয়ার অন টেরর’ নাম দিয়ে। কিউবায় নৌ ঘাটি ‘গুয়ান্তোনামো বে’ তে শয়ে শয়ে আরব বন্দীদের উপর অমানবিক অত্যাচার নির্যাতন পরিচালনা করে আমেরিকা। পৃথিবী কেবল নীরব সাক্ষী। ইরাকে ‘আবু গারিব’ বন্দী শালায় যুদ্ধবন্দী আর সন্দেহ ভাজনদের উপর অকথ্য মধ্যযুগীয় কায়দায় অত্যাচার, এ সব কিছু মানুষ দেখেছে ঘৃণাার চোখে। এশিয়া আফ্রিকার কোটি মানুষকে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা আর বাসস্থান বঞ্চিত রেখে আমেরিকা ইউরোপ জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধে। এ যুদ্ধ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। অথচ এশিয়া আফ্রিকার দারিদ্র পীড়িত মানুষগুলো খাদ্যের অভাবে হাহাকারে। এরপর মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম যুদ্ধে অবলীলায় আমেরিকা ইউরোপের ইন্ধন। ‘গাজা’ আগামী প্রজন্মের মানুষ নিশ্চিতভাবে এ নামটি উচ্চারণ করবে মানুষ কীভাবে চরম অবজ্ঞায় অনাদরে নির্মমতায় মানুষকে অবরুদ্ধ করে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে সে উদাহরণ হিসাবে। ‘গাজা’ অনাদিকালের মানুষের কাছে উচ্চারিত হবে মানুষ কিভাবে ক্রমাগত বিধ্বংসী বোমাবর্ষণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, যাবতীয় অবকাঠামো ধ্বংস করে মানুষের মানবিকতাকে ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে তার উদাহরণ হিসাবে। আগামীর মানুষ জানবে কিছু মননশীল মানুষের ক্রমাগত প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে কীভাবে আমেরিকা ইউরোপ কাণ্ডজ্ঞানহীন চরম বর্বর ইসরাইলী নেতাদের পাশে নিরীহ মানুষ মারতে সর্ব্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
উদৃত এসব অন্যায় অবিচার নিষ্ঠুরতার প্রতিকারে কি মানুষের স্রষ্টা রুদ্ররোষে অমোঘ প্রতিশোধ নিতে প্রকৃতিতে সৃষ্টি করেন সাইক্লোন, মহামারী, প্লাবন আর দাবানল?
৭ জানুয়ারী ২০২৫ কালিফোর্নিয় অঙ্গরাজ্যের লস এঞ্জেলেসে দাবানলের উৎপত্তি ঘটে। এই দাবানল ক্রমে ভয়ানক রূপে বিস্তার লাভ করে। উৎপত্তিস্থল থেকে ক্রমাগত এ দাবানল ৬টি ভাগে বিভক্ত হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে রীতিমত প্রলয় নাচন নাচে। হাজার হাজার ফায়ার ফাইটারকে ব্যর্থ করে শেষ খবর অনুযায়ী এ দাবানল প্রায় ১৩ হাজার বাড়ি ঘর ভস্মে পরিণত করে। নানা হিসাব অনুযায়ী লস এঞ্জেলেসের এ দাবানল এখন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াল এবং বিধ্বংসী। লস এঞ্জেলেসের এ দাবানল মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে পরিগণিত হতে যাচ্ছে। আবহাওয়াবিদ এবং পরিসংখ্যানবিদদের হিসাব অনুযায়ী এ দাবানলের ক্ষতি ১৫০ থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলার।
দাবানলের করাল থাবা থেকে রক্ষার জন্য ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
একদিকে বাতাসে আদ্রতা কম অন্যদিকে বাতাসের গতিবেগ কেবলি বাড়ছে, এ গতি ৮০ থেকে ১১২ কিঃমিঃ এ রূপ নিতে পারে ফলে লস এঞ্জেলেসের দাবানল আরো বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কেবলি বাড়ছে। বাতাসের গতিবেগ বাড়াকে আমেরিকানরা ‘উইন্ড অব ডেবিল’ অর্থাৎ শয়তানের বাতাস বলে আখ্যায়িত করছেন। দাবানল নিয়ন্ত্রণে মেক্সিকো থেকেও ফায়ার ফাইটার আনা হয়েছে।
আমেরিকানদের জন্য বেদনার এবং লজ্জার দাবনলের কবলে পরা মানুষদের বাড়িঘর লুটপাট হচ্ছে আরেকদল হৃদয়হীন লুঠেরাদের দ্বারা এরা ফায়ার ফাইটারের বেশে চৌর্যবৃত্তিতে রত।
সব মিলিয়ে আমেরিকার সবচেয়ে বনেদি অঞ্চল লস এঞ্জেলেস এখন অনেকটা বিরান ভূমি। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের মালিক সেলিব্রেটিদের অনেকেই রাতারাতি গৃহহীন। আমেরিকানদের সামর্থ আছে এ ক্ষতি তারা পুষিয়ে নিতে পারবেন নির্বিঘ্নে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণ এই বিধ্বংসী প্রলয় নাচনের মাঝে আমেরিকান তথা মানুষের জন্য সার্ব্বিকভাবে স্রষ্টার এক পারলৌকিক বাণী বিদ্যমান। এই মর্মবাণী যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীর লক্ষ মানুষের শোকার্ত কান্নায়, অভূক্ত মানুষের আহাজারিতে, বিধ্বংসী বোমার বিকটতায় নীরবে কান পাতলে অনুরণিত হবে। এ লেখা প্রকাশিত হবার পরদিন অর্থাৎ আগামীকাল ডোনাল্ড ট্রাম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করবেন। তিনি লস এঞ্জেলেস এর দাবানল ঘিরে স্রষ্টার অমোঘ বাণী কান পেতে শুনলে পৃথিবীর মানুষ অনেক স্বস্ত্তিতে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে এটা নিশ্চিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।