একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতাদর্পী মানুষেরা এখনও যুদ্ধ উন্মাদনায় উন্মত্ত একথা পৃথিবীর অনাগত প্রজন্মসমূহ কিভাবে গ্রহণ করবে আমার ভাবতে বেশ কষ্ট হয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা ভাবলে তা আমাকে অবাক করে। কারণ আমেরিকা শিক্ষায়, চিন্তা–চেতনায়, আবিষ্কারে, পৃথিবীর সামনে জ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনে এ পৃথিবীতে একেবারে সম্মুখ সারিতে।
যে আমেরিকা বিশ্বে এমন একটি অবস্থানে সে আমেরিকাই পৃথিবীর বুকে হিরোশিমা–নাগাসাকিতে প্রথম আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে অগনিত মানুষের মুত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং সেই কলংক তিলক এখনও স্বীয় কপালে বয়ে বেড়াচ্ছে। যে আমেরিকায় পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সমাবেশের মাধ্যমে এক অভিনব সংস্কৃতির মেলবন্ধন সৃষ্টি হচ্ছে সে আমেরিকাই পৃথিবীর দেশে দেশে লক্ষ মানুষ হত্যার নজির সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ ভিয়েৎনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে বিশ বছর ধরে ক্রমাগত বোমাবর্ষণ আর স্থল যুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা, মিথ্যা অজুহাতে সভ্যতার পাদপীঠ ইরাক আক্রমণ করে নির্বিচারে ধ্বংসলীলা চালানো, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়ামেনে নির্বিকার মানুষ হত্যার পাপ আমেরিকাকে বয়ে বেড়াতে হবে জাতি হিসাবে। গাজার গণহত্যায় শুধু ইন্ধন নয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবে চার চারবার ভেটো প্রয়োগ করে আমেরিকা পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতার, নৃশংসতা আর গণহত্যার পক্ষ নেওয়ার এক ঘৃনিত নজিরও স্থাপন করেছে। অথচ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মোট ১৫ সদস্যের ১৪ সদস্যই গাজায় যুদ্ধ বিরতির পক্ষে ভোট দেয়। এরই প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধির বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেছেন “যুদ্ধ বিরতির বিরুদ্ধে আমেরিকার এ অবস্থান এ কথাই প্রমাণ করে তারা ইসরাইলকে নির্বিচারে মানুষ হত্যায় উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন”।
এখানে উল্লেখ্য ইতিমধ্যে গাজায় অকল্পনীয় ধ্বংসলীলা এবং নির্বিচার গণহত্যার দায়ে আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং তার প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্ট’এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আশ্চর্য্যের বিষয় আমেরিকা আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত’এর এ গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধেও অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ আস্কারা আর সমর্থনে এভাবেই পৃথিবীর সভ্যতাদর্পী মানুষের চোখের উপর এক বছরের বেশী সময় ধরে গাজায় ইসরাইলীদের অসভ্য বর্বরতা চলমান।
মনরো ডকট্রিনের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়েছিল পৃথিবীর সাধারণ মানুষ মনে করেছিল ৯ নভেম্বর ১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়ালের ভাঙনের পর সে স্নায়ূ যুদ্ধের অবসান হতে চলেছে। এর বোধ জাগ্রত হওয়ার পিছনে কারন ছিল তৎকালীন সোভিয়েৎ ইউনিয়ন তার নেতৃত্বে গঠিত “ওয়ারশ ” সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিল। কিন্ত্তু পরবর্তীতে দেখা গেল আমেরিকার নেতৃত্বে গঠিত ন্যাটো জোট আমেরিকা বিলুপ্ত করেনি। যদিও সে সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকার ঘোষণা বা এ নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন ন্যাটো কখনো পূর্বমুখী তথা তার কোন কর্মকাণ্ড রাশিয়াভিমুখি হবেনা। ন্যাটো এ প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। ন্যাটো সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলিতে একের পর এক প্রভাব বলয় সৃষ্টি প্রচেষ্ঠার মাধ্যমে তাদের ন্যাটোভুক্তির প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। এরই ফলশ্রুতি ৮ আগস্ট ২০০৮ সালে বিশ্ব যখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বেজিং অলিম্পিক উপভোগ করছিল তখন পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত থেকে বিখ্যাত সব ইলেট্রনিক মিডিয়া খবর দিতে থাকে জর্জিয়ার সৈন্যরা ইংগোসেটিয়ায় অভিযান পরিচালনা করছে, দলে দলে রুশভাষাভাষী লোকজন শরর্নাথী হয়ে রূশ অঞ্চলের দিকে যাত্রা করেছে। শুধু এই নয় ইংগোসেটিয়ায় জর্জিয় আক্রমণে বহুলোক হতাহত হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বেজিং এর অনুষ্ঠান ছেড়ে উড়াল দেন মস্কোয় নয় সোজা ইংগোসেটিয়ার ফ্রন্ট লাইনে, সৈন্যদের আদেশ দেন প্রয়োজনে যে কোন শক্তি ব্যবহারে নির্বিঘ্ন থাকতে। সেই সময়ের জর্জিয় প্রেসিডেন্ট সাকাসভেলী বিশ্বকে জানান দেওয়ার আপ্রান চেষ্ঠা করেন এই বলে “রাশিয়া জর্জিয়দের বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করছে, সেকথা কানে তুলে জর্জিয়ানদের সাহায্যে তখন কেউ এগিয়ে যায়নি। রাশিয়া তার শক্তিবলে জর্জিয়দের শায়েস্তা করে। এখানে উল্লেখ্য জর্জিয়া আমেরিকাকে তুষ্ট করতে ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা, বৃটেনের পর তৃতীয় সংখ্যা গরিষ্ঠ সৈন্য প্রেরণকারী দেশ ছিল।
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রুশপহ্নি প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকুভিচ ক্ষমতাচ্যুত হলে রাশিয়া ক্রিমিয়ায় তার কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখতে ২৭ ফেব্রুয়ারি ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। এ ঘটনার পরও ন্যাটো তার পূর্বমুখী কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত হয়নি। বরং পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরী, মলদোভা,চেকোস্লোভাকিয়া, ইউক্রেন ইত্যাদি দেশ সমূহকে ভিত্তি করে কেবলি তার প্রভাব বিস্তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এরই ক্রমধারা ইউক্রেন।
ইউক্রেন যুদ্ধ অনেকটাই ন্যাটোর ইন্ধনে ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হয়। এ যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলি সর্বাত্মকভাবে ইউক্রেনকে আর্থিক এবং সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি রাশিয়ার উপর ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ ও চলেছে। রাশিয়া এ সমস্ত অবরোধ এ যাবতকাল বেশ সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করে এসেছে। রাশিয়া তার উপর আরোপিত অবরোধ মোকাবেলায় চীন,ইরান, ভারত এবং উত্তর কোরিয়াকে কার্যকরভাবে পাশে পেয়েছে।
চীন এবং ভারত পারস্পরিক স্বার্থে বিপরীতমুখী অবস্থানে অবস্থান করলেও পশ্চিমের অবরোধকে গ্রাহ্য না করে উভয়েই রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানী তেল কিনতে সামান্য পিছপা হয়নি। একই ভাবে পশ্চিমের রক্তচক্ষুর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে ইরান ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে তার যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত কামিকাজে ড্রোন দিয়ে ক্রমাগত সাহায্য করে যাচ্ছে। র্স্বশেষ যে তথ্য পশ্চিমা বিশ্বকে চরমভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে তা হল রাশিয়ার ক্্রুস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উত্তর কোরিয়ার ১২০০০(বার হাজার) সৈন্য প্রেরণ।
এমন এক প্রেক্ষাপটে আমেরিকা ১৯ নভেম্বর ২০২৪ ইউক্রেনকে ইতিমধ্যে সরবরাহকৃত তার দূরপাল্লার কামান রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করে। ২০ নভেম্বর ২৪ ইউক্রেন যুক্তরাজ্য কতৃক সরবাহকৃত “স্যাডো স্টর্ম” দূর পাল্লার মিসাইল রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এসব দূরপাল্লার অস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে কয়েকটি সামরিক শিল্প কারখানায় আগাত করলেও অধিকাংশ রাশিয়ান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম প্রতিহত করে।
এরই প্রতিক্রিয়া হিসাবে ২১ নভেম্বর ২০২৪ রাশিয়া তার দূর পাল্লার “ওরেস্নিক” ক্ষেপনাস্ত্র ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এই ক্ষেপণাস্ত্র ৫৫০০ কিঃ মিঃ দূরত্বে শব্দের চেয়ে ১০ গুন গতিতে লক্ষ্যবস্ত্তুর উপর আঘাত হানতে সক্ষম। ইউক্রেনে ছোড়া “ওরেস্নিক”মিসাইলের নিখুঁত নিশানা বেদের পর পরই রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন “ওরেস্নিক”মিসাইলকে ঠেকানোর কোন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম পৃথিবীতে এখনো স্থাপিত হয়নি। একই সাথে পুতিন আরো ঘোষণা করেন, যেসব দূর পাল্লার অস্ত্র ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, সেসব অস্ত্র সরবরাহকারীদের দক্ষ লোকজনদের সহায়তায় ছোড়া হয়েছে। এই সূত্রে আমরা ঐসব দেশকে আমাদের নিশানায় আনব।
এরই মাঝে বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রকে উদ্ধৃত করে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, রাশিয়া পোল্যান্ড এবং ইউরোপিয় বিভিন্ন দেশকে লক্ষ্য করে তার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা নিয়োজিত করেছে। এমন অবস্থায় যুক্তরাজ্য তড়িঘড়ি তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পরিস্থিতি বিবেচনায় বৈঠক আহ্বান করে। ঐ বৈঠকে বৃটিশ জেনারেল ম্যাকগ্র, বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের জানান তারা ঐ রাতেই যুদ্ধ মোকবেলায় প্রস্ত্তুত আছেন। ফরাসী সরকারও ইতিমধ্যে তাদের দূর পাল্লার অস্ত্র ব্যবহারে ইউক্রেনকে অনুমতি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। পুতিন ত ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন রাশিয়ার প্রয়োজনে তিনি পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করবেন না।
এমন পরিস্থিতিকে জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিল ডাউফট বিশ্বের জন্য “ড্্রামাটিক এন্ড ডেন্ঞ্জারাস” বলে উল্লেখ করেছেন। সামরিক বিশ্লেষক এ্যানি জ্যাকেভসন উল্লেখ করেছেন “পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হলে একজন মাত্র ব্যক্তির একটি আঙ্গুলের চাপে যুদ্ধের প্রথম ৭২ মিনিটে পৃথিবীর ৬০% মানুষের মৃত্যু ঘটবে”। এসব বিষয় বিবেচনা করেই হয়ত আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন জো বাইডেন তার বিদায়ের প্রক্কালে পৃথিবীকে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকির মুখে রেখে যাচ্ছেন।
মনে হয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পৃথিবীর বুকে এডলফ হিটলার, মুসোলিনি, ট্রু ম্যান, চার্চিল, স্টালিনদের মত বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। না হয় তার অজানা থাকার কথা নয় পৃথিবীর বুকে পূর্বের দুটি বিশ্ব যুদ্ধ মানুষের জন্য কি বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। সে বিপর্যযের কথা বাইডেন পুতিনদের জন্য আরো একবার উল্লেখ করছি।
১৯১৪ থেকে ১৯১৮ তে শেষ হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, এর মাঝে প্রায় ২ কোটি সামরিক বাকীরা বেসামরিক মানুষ। অজস্র মানুষের এই মৃত্যু– দুর্ভোগ বিশ্ব নেতারা বিশেষ করে ইউরোপিয়রা অচিরেই ভুলে যায়। তারা এই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ থেকে আরো ভয়াবহ এবং বিশাল ব্যাপ্তিতে দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্বে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতার ভয়াল রুপ পৃথিবীর মানুষ অসহায় হয়ে কেবল দেখেছে। ১৯৩৯শে শুরু হয়ে ১৯৪৫ এ শেষ হওয়া এই যুদ্ধে ৭ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। এর মাঝে ২ কোটি সামরিক আর বাকীরা বেসামরিক। এ সমস্ত জানা থাকা সত্তেও পৃথিবী এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক