বেশ সময় নিয়ে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ সমূহ এবং ভারত – বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক নিয়ে ধারাবাহিক লেখাটি লিখছিলাম। এর মাঝে এমন এমন ঘটনা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ঘটে যাচ্ছে যেগুলি পাঠকদের সামনে তুলে না ধরতে পারা পাঠকদের কাছে এক ধরনের দায়বদ্ধতার ভারে আক্রান্ত থাকার মত। এ তাড়না থেকেই ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চল নিয়ে লেখাটির সাময়িক বিরতি টেনে এ লেখাটি লিখছি। সমস্ত পৃথিবীকে অনেকটা তাচ্ছিল্যের অতলে ঠেলে ফেলে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে গাজা’য় যেমন ইসরাইল নির্বিচারে মানুষ হত্যায় মত্ত তেমনি লেবাননেও চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ। এ সমস্ত ঘটনার কথা বলতে গিয়ে ‘ফিলিস্তিনের এক অসীম সাহসী যোদ্ধার কাব্যিক আহবান’ লেখাটির অবতারনা। এ প্রসঙ্গে ৮ নভেম্বর কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা’র মাধ্যমে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদন রীতিমত সমগ্র মানবজাতির জন্য এক মর্মান্তিক বেদনার্ত বার্তা বয়ে এনেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন’এর ঐ প্রতিদেনে বলা হয়েছে গাজায় ইসরাইলী হামলায় নিহত প্রায় ৪৫০০০ লোকের মাঝে ৭০ শতাংশই শিশু এবং নারী। ১৬৭০০(ষোল হাজার সাতশত) নিহত শিশুর একজন ১০ বছরের রাশা। রাশা আর তার ১১ বছরের ভাই আহমেদ বেশ কয়েকবার ইসরাইলী বিমান আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এসব থেকে শিশু রাশার হয়ত মনে হয়েছিল এভাবে আর কতবার বাঁচা যায়। তাই রাশা মরে গেলে তার ছোট্ট জীবনের সঞ্চিত জিনিসগুলি কাকে কী দেবে তার একটি ইচ্ছাপত্র সে লিখে রাখে। এই ইচ্ছাপত্রটি ’আসেম আলনাবিহ’ নামক এক পি এইচ ডি গবেষকের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ জানার সুযোগ পেয়েছে। রাশার ইচ্ছাপত্রটি ছিল এরকম ‘আমার ইচ্ছা, আমি যদি শহীদ হই বা মারা যাই, তোমরা আমার জন্য কেঁদো না। তোমরা কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। অভাবী যারা আমার জামা কাপড়গুলি তাদের দিয়ে দিও। খেলনাগুলি রাহাফ, সারা, জুডি, লানা আর বাতুলকে ভাগ করে দিও। পুঁতির মালাগুলো আহমেদ আর রাহাফ’এর জন্য। আমার প্রতি মাসের ৫০ শেকেলের অর্ধেক আহামেদ আর অর্ধেক রাহাফকে দিও। আমার গল্পের বইগুলোও রাহাফের জন্য। আমার ভাই আহামেদ’কে তোমরা বকা দিও না’। ইসরাইলীদের বোমাবর্ষণে রাশা আর তার ভাই আহমেদ একই সাথে মৃত্যু বরণ করে, দুজনকে পাশাপাশি কবরস্থ করা হয়। হিন্দরেপ নামের যে শিশুটি বাবা মা ভাই সবাইকে হারিয়ে বিধ্বস্ত কারের ভিতর আরো ১২ দিন বেঁচেছিল এবং শেষ পর্যন্ত উদ্ধার না হয়ে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়েছিল। রাশা, আহমেদ আর হিন্দরেপ’দের মত আরো কত হাজারো শিশুর জীবন গাজাতে, লেবাননে অকাতরে বিলীন হচ্ছে তা বিশ্ব–বাসীর অজান্তেই থেকে যাচ্ছে। এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে এইসব শিশুদের জীবন বাঁচাতে, মানুষকে মানুষের মত মর্যাদার সাথে জীবন যাপনে তার অধিকার আদায়ে যে মানুষটি একেবারে সম্মুখ থেকে জীবনপণ লড়ে গিয়েছিলেন তার নাম ইয়াহিয়া সিনওয়ার। গত সপ্তাহে তার কাব্যিক আহবানের প্রথম পবর্টি তুলে ধরেছিলাম। ১৬ অক্টোবর ২০২৪ ইয়াহিয়া সিনওয়ার ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর হাতে শহীদ হন। ইসরাইলী মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশনের পোস্ট মর্টেম রির্পোট এর বরাতে ইতিমধ্যে জানা গেছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা সিনওয়ার অভূক্ত ছিলেন। এ থেকে এখন বিশ্ব বাসীর সামনে ইসরাইলীদের গাজায় খাদ্য সরবরাহ অবরোধের বর্বরতার বিষয়টি আরো স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার’ এর কাব্যিক আহবান’এর আজ দ্বিতীয় পর্ব :
৫.
আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের
শুরু করা আরাধ্য অর্জনে নিবেদিত,
আমরা কখনো লক্ষ্য অর্জনে
পিছপা হব না, তা
যত ত্যাগের বিনিময়েই হউক।
গাজা অতীত, বর্তমানের মত
ভবিষ্যৎ এও অবিচলতার কেন্দ্রস্থল
হয়ে থাকবে, ফিলিস্তিনের হৃদপিণ্ড
গাজা, সমস্ত পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নিলেও
তার হৃদস্পন্দনে অবিচল থাকবে।
২০১৭ সালে আমি যখন গাজা এবং
হামাস’এর নেতৃত্ব গ্রহন করি তখন এটি
শুধু মাত্র ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল না, বরং
এটি ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধেরও ধারাবাহিকতা
এটি ছিল পাথর ছোড়া থেকে
রাইফেলের ব্যবহারের পথ চলার
উত্তরাধিকারের ভারবহন ধারার দায়িত্ব গ্রহণ।
আমি প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত
আমাদের অবরুদ্ধ জনগণের ব্যথা
উপলব্ধি করেছি, আমি এটি জানি
স্বাধীনতা অর্জনের পথে আমাদের
নেওয়া প্রতি পদক্ষেপেই আমাদের
মূল্য দিতে হচ্ছে–
৬.
তবে আত্মসমর্পণ আমাদের জন্য
আরো মারাত্মক ফল বয়ে আনবে
তাই শিকড় যেমন যেকোন ঝড়
মোকাবিলায় মাটিকে আঁকড়ে ধরে থাকে
তেমনি জীবনের তরে
আমাদেরও প্রাণপণ লড়ে যেতে হবে।
আল আকসা ফ্লাড যুদ্ধে
আমি কোন দলের নেতা বা আন্দোলনের
উদগাথা ছিলাম না
বরং আমি ছিলাম সমস্ত ফিলিস্তিনিদের
কণ্ঠস্বর, যারা স্বাধীনতার স্বপ্নে
বিভোর।
আমি এই বিশ্বাসের তাড়নায় তাড়িত
হয়েছি, প্রতিরোধ যুদ্ধ কোন পছন্দ
অপছন্দের বিষয় নয়
এটা কর্তব্যের বিষয়।
আমি মনে প্রাণে চেয়েছি এই যুদ্ধ
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে
একটি নতুন অধ্যায় হিসাবে
সংযোজিত হউক, এ যুদ্ধ কোন
একটি উপদলের ছিল না বরং আমরা
সম্মিলিতভাবে একই সংকল্পে
শক্রর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, যে শক্র
শিশু এবং বয়স্কদের মাঝে কোন পার্থক্য করে না
সব নির্বিশেষে নিশানায় পর্যবসিত করে।
৭.
আল আকসা যুদ্ধ একসময় ছিল অস্ত্রের
তারপর এটি ইচ্ছা শক্তির আর
মুখোমুখি যুদ্ধে পরিণত হয়
আর এখন এটি আধ্যাত্মিক পর্যায়ের এক যুদ্ধ।
আমি যা রেখে যাচ্ছি তা
আমরা যারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার
স্বপ্নে বিভোর হয়েছি, যে মা তার শহীদ
সন্তানকে কাঁধে নিয়ে আহজারী
করেছে, যে বাবা ছুটে আসা বুলেটে
নিহত কন্যার লাশ নিয়ে
করুন বিলাপ করেও স্বাধীনতার
স্বপ্ন তিরোহিত হয়নি
তাদের সম্মিলিত ত্যাগের মহিমার
উত্তরাধিকার।
আমার আপনাদের প্রতি চূড়ান্ত এবং
উদাত্ত আহবান, এটি মনে রাখবেন
প্রতিরোধ যুদ্ধ কোন ভনিতা নয়
৮.
এটি শুধু মাত্র কোন গুলি ছুড়ে মারা নয়,
বরং যাপিত জীবনের এটি
সম্মান ও গৌরবকে বহন করে।
অবরুদ্ধ এবং বন্দীত্বের জীবন
আমাকে এই শিক্ষাই দিয়েছে
স্বাধীনতার পথ কঠিন এবং র্দীঘ
এ চলার পথ আমাকে এ শিক্ষাও
দিয়েছে,
যারা কখনো আত্মসর্মপণ করে না
তারা নিজ হাতে স্বাধীনতা অর্জনের
আলোক বর্তিকা সৃষ্টি করে।
পৃথিবী আপনার প্রতি ন্যায় পরায়ন হবে
এটা আশা করবেন না,
আমি দেখেছি আমাদের উপর বয়ে যাওয়া
নির্মমতা পৃথিবী কিভাবে নিঃশ্চুপ
অবলোকন করেছে।
আমাদের প্রতি ন্যায় বিচার করা হবে
সে আশায় অপেক্ষায় থাকবেন না
বরং নিজের স্বাধীনতার স্বপ্নকে
এগিয়ে নিয়ে নিজের প্রতি নিজে ন্যায় বিচার করুন,
হৃদয়কে কঠিন করুন প্রতিটি আঘাত আর প্রতি ফোটা
অশ্রুকে আশায় রূপান্তর করুন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক