সমকালের দর্পণ

ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশসমূহ : ভারত - বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক - ৭

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৩ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

অরুন্ধতী রায় ৫ জুন ২০১১ লন্ডনে ভারতীয় সেই প্রশ্নকর্তার প্রশ্নোত্তরে বলতে থাকেন “আপনারা জানেন, ২০০২ সালে ভারতে কী হয়েছিল, কাশ্মীরে ধর্মের নামে ৭০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যার কথা নাইবা বললাম। ২০০২ সালে গুজরাটে কী হয়েছিল? এক কর্মসূচির মাধ্যমে ২ হাজারের বেশি মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। মুসলিম মহিলাদের গণধর্ষণ করা হয়েছিল। মানুষদের পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে গৃহহারা করা হয়েছিল। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। এহসান জাফরী একজন মুসলমান এমএলএ ছিলেন। তিনি যেহেতু মেম্বার লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি, তাই ভীতসন্ত্রস্ত মুসলমানরা নিরাপত্তার জন্য তার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ভয়তাড়িত মানুষগুলো মনে করেছিল, এহসান জাফরী বাড়ীতে তারা নিশ্চিত নিরাপদ। ২০ হাজার উগ্র, উচ্ছৃঙ্খল জনতা এহসান জাফরীর বাড়ি ঘেরাও করে। এহসান জাফরী পুলিশের সাহায্য চান, তিনি সোনিয়া গান্ধীর কাছে সাহায্য চান, যাদের হাতে রাজ্যের ক্ষমতা (নরেন্দ্র মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী) তাদের সাহায্য চান। নিরাশ, আশাহত এহসান জাফরী অবশেষে উগ্র উচ্ছৃঙ্খল সেই জনতার মুখোমুখি হন।

এহসান জাফরীর উচ্ছৃঙ্খল সেই জনতার উদ্দেশে নিবেদন ছিল, আপনাদের প্রতিনিধি আমি, আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আমার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া নারীশিশুদের কোনো ক্ষতি আপনারা করবেন না। তাদের নিরাপদে এখানে অবস্থান করতে দিন। সেদিন এহসান জাফরীর সেই আবেদন শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং এহসান জাফরীর হাতপা বেঁধে তাঁকে টুকরা টুকরা করে আগুনে পোড়ানো হয়। ৬৫ জন নারীকে গণধর্ষণ করা হয়। এহসান জাফরীর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বছর দুয়েক পরে গোপন আদালতে (ক্যামেরা কোর্ট) এ হত্যাকান্ডের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। কাঠগড়ায় আসামিরা অবলীলায় তাদের কৃতকর্ম স্বীকার করে, এই বাক্‌স্বাধীনতার ভারতে বাবু বজরঙ্গি বুক ফুলিয়ে আদালতের সামনে কতজন মুসলিমকে সে হত্যা করেছে তার সবিস্তার বর্ণনা দেন। অপরাধীরা কতজন নারীকে ধর্ষণ করেছে, তা সগৌরবে বর্ণনা করেছে। এহসান জাফরীকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার সবিস্তার বর্ণনা তারা দেয়। সবই বাক্‌স্বাধীনতার ভারতে মুক্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও অপরাধীদের কোনো শাস্তিই হয়নি। মানুষের ধারণা, গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটিয়েছেন। উদ্দেশ্য, উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির মাধ্যমে হিন্দু ভোটারদের দলে টানা। নরেন্দ্র মোদি এতে চূড়ান্ত সফল। এখন তিনি ভারতের মহাপ্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী। এর আরও প্রকৃষ্ট উদাহরণ আসামে ২০১৬ সালে বিজেপির ক্ষমতারোহণ এবং বর্তমানের আসামের দৃশ্যপট”।এসব বিষয় অনুধাবন করে এবং বিবেচনায় নিয়ে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের উত্তর প্রদেশের সেই সময় দায়িত্বে থাকা পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ১২ মার্চ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্র রাজ্যসভার কংগ্রেস পার্টি আয়োজিত প্রথম প্রচার সভায় উল্ল্লেখ করেন, ‘এই দেশের চরিত্র এমন, ভালোবাসায় ঘৃণা উড়ে যাবে। এ জাতি গড়ে উঠেছে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর। কিন্তু আজ দেশে যা ঘটছে তা দুঃখজনক। আমি পীড়া অনুভব করি যখন দেশের বর্তমান অবস্থা প্রত্যক্ষ করি। সারা দেশে ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে’।

লোকসভায় প্রার্থী ঘোষণা করতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে প্রায় একই সুরে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। ‘দেশে একটি বিদ্বেষবিভেদের রাজনীতি চলছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতায় সংখ্যালঘুদের সমস্যা বেড়েছে। গোরক্ষক, গণপিটুনির সিন্ডিকেট গড়া হয়েছে দেশজুড়ে। বিজেপির উগ্রবাদের রাজনীতি দেশকে টুকরা করার চক্রান্তে লিপ্ত’। ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছেন, নির্বাচিত হলে তাঁরাক। আসামের এনআরসি কার্যকর করবে। (অর্থাৎ ৪০ লাখ অসমীয়কে আসামছাড়া করবে)। খ। পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

উল্লেখ্য, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চিহ্নিত অধিবাসীর মধ্যে শুধু মুসলমানদেরই বহিষ্কার করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ভারতীয় টিভি চ্যানেল এনডিটিভি তাদের খবরে জানায়, ভারতীয় পূর্বাঞ্চল আসামে সম্প্রতি পরিচালিত জরিপ এবং ৩০ জুলাই ২০১৮ তে প্রকাশিত এন আর সি’তে মায়ের নাম না দেখে বিনয় চাঁদ “ফরেইনার’স ট্রাইব্যুনাল” এ আবেদন করেন। এই আপিলের পেছনে দিনমজুর বিনয় চাঁদ তাঁর মা শান্তি চাঁদের নাম এনআরসিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য তাঁর যা সামান্য জমাজাতি ছিল, সব ব্যয় করে নিঃস্ব হয়ে পড়েন।

আদালতে বিনয় চাঁদের আবেদন ছিল, ‘They have had documents of 1960, they have been voting in every election yet the foreigner tribunal adjudged them as doubtful citizen and that why they had no other to go to high court, such legal battle is difficult for poor people so he come under huge stress’. তাদের ১৯৬০ সালের দলিলাদি রয়েছে, সেই থেকে প্রতিটি র্ন্বিাচনে তারা ভোট দিয়েছেন, এতদসত্তেও বিদেশী নির্ধারণী আদালত বিনয় চাঁদের মায়ের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে তাকে উচ্চ আদালতে আপিল করতে বলেন, ইতিমধ্যে প্রায় নিঃস্ব হওয়া বিনয় চাঁদের পক্ষে তা দুরূহ হয়ে পড়ে। বিনয় চাঁদকে বিষয়টি প্রচন্ড মানসিক চাপে ফেলে নিঃস্ব অপমানিত বিনয় চাঁদ সে চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আত্মহত্যার মাত্র ২০ দিন আগে বিনয় ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছিলেন।

Why she is angry. The Telegraph তাদের ৩ আগস্ট ২০১৮ তে এই শিরোনামে আসামের দুবরি জেলার ফকিরগঞ্জের ফুলবাসু দেবীর দুঃখের কাহিনি ছাপিয়েছে। সত্তরোর্র্ধ্ব ফুলবাসু দেবী আসাম পুলিশের সাবেক কনস্টেবল মৃত জগদেব পান্ডের স্ত্রী। তাঁর পরিবারের ১৬ সদস্যের অন্য সবার নাম এনআরসিতে রয়েছে, কিন্তু তাঁর নাম নেই। এদিকে রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে বিজেপি’র তৎকালীন সভাপতি অমিত শাহ ঘোষণা করেন, যাদের নাম এন আর সি’তে নেই, তারা সব এযঁংঢ়বঃরুব বা বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী। এই অনুপ্রবেশকারী বলাতেই ফুলবাসু দেবীর যত রাগ আর ক্ষোভ। তাঁর ছেলে মনোজ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘How can my mother be a Ghuspetiye? Our ancestors are from undivided Bihar not from Bangladesh. A large number of people who missed the NRC draft have origin in other states of the country like Bihar, Bengal and Jharkhand. So, if they call us all Ghuspetiye, it is insulting and insensitive towards them. মনোজের কথা হল আমর পূর্ব পুরুষরা অবিভক্ত বিহার থেকে আসামে এসেছে, তাহলে আমার মা কি করে অনুপ্রবেশকারী হন। আসামের প্রচুর সংখ্যক মানুষ এসেছেন বিহার, পশ্চিম বাংলা আর ঝাড়খন্ড অঞ্চল থেকে। এখন যদি কেউ আমাদের সবাইকে অনুপ্রবেশকারী বলেন তাহলে তা হবে দায়িত্বজ্ঞানহীন আর আমাদের জন্য অপমান জনক মন্তব্য।

২৩ মে ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এদিন বিজয় উৎসবে বিজেপি উল্ল্লসিত আর এই একই দিন আসামের কামরুপ জেলার কলিকাস গ্রামের লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ সানাউল্লাহর জীবনে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। মোহাম্মদ সানাউল্লাহ ৩০ বছরের বেশি সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেছেন। সেনাবাহিনীতে থাকার সময় দেশের হয়ে বহু অভিযানেও অংশগ্রহণ করেছেন। এই লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ সানাউল্লাহকে Foreigner’s Tribunal কোর্ট ভারতীয় নয় বলে ঘোষণা করেছেন। অতঃপর সানাউল্লাহকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ Detention camp বা বন্দি শিবিরে এ নিয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে সানাউল্লাহর চাচাতো ভাইয়ের খেদোক্তি, ‘Nothing is more heartbreaking than an ex-serviceman being treated like this’. অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর একজন প্রাক্তন সদস্যের সাথে এরকম আচরণ, এর চেয়ে হৃদয় বিদারক আর কিছুই হতে পারে না। ভারত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশে বর্তমানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার রয়েছে। এই নির্বাচিত সরকার জনগণের স্বার্থের কথা বলে আসামে ৪০ লাখের বেশি সাধারণ মানুষকে ভারতীয় নয় বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের জন্য একধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ যেমন সৃষ্টি করছে, তেমনি বিষয়টি প্রতিবেশী দুটি দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক গভীর সংকটের ইঙ্গিতবহ। কারণ, ভারতীয় জনতা পার্টির শীর্ষ নেতারা কোনো রকম রাখঢাক না করে বলে বেড়াচ্ছেন, আসামের বর্ণিত এই ৪০ লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে আসামে অনুপ্রবেশকারী। আসামের বাঙ্গালী মুসলমানদের ব্যাপারে ভারতীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের এ ধরনের মনেবৃত্তি ভবিষ্যৎ এ বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ককে সব সময় কন্টকার্কীণ করে রাখবে বলেই প্রতীয়মান।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে