২০২১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী পালিত হয়। এ অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি সম্মানিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানের আগের দিন প্রণব সাহার উপস্থাপনায় এটিএন নিউজ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানটিতে আমি সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক জনাব দেরওয়ার হোসেন, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত এবং একটি ইসলামী দলের মাওলানা মিজবাহুল উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করি। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। আলোচনার বিষয় ছিল ‘আবার সেই পাকিস্তানী ধারা’।
আলোচনার সূত্রপাত করতে গিয়ে উপস্থাপক উল্লেখ করেন ঢাকা সহ দেশের নানা স্থানে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিষয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে উপস্থাপক আমাকে আমার মন্তব্য উপস্থাপন করতে আহবান জানান। সেদিন আমি আমার অভিমত ব্যক্ত করতে যে বিষয়গুলির অবতারণা করেছিলাম আজও আমার এ লেখার জন্য তা প্রাসঙ্গিক মনে করে এখানে তুলে ধরছি।
আমার মন্তব্য ছিল এরকম। আমাদের জাতির জনক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তার চারটি ঘোষিত নীতি ছিল। এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য দুটি হল ধর্ম নিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। ধর্ম নিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের জন্ম। এ দুটির প্রতি আস্থা আর সমর্থন না থাকলে বাংলাদেশের অভ্যূদয় হত না। কারণ এটা কারো অজানা নয় বাঙালিরা গরিষ্ঠ সংখ্যক মুসলমান তেমনি পাকিস্তানীরাও মুসলমান। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ধর্ম প্রাধান্য পায়নি। জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতা প্রাধান্য পেয়েছে। এমন এক ভিত্তি ভূমিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসছেন। এটা সর্ব্বজন বিদিত তিনি একজন আদ্যপান্ত সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তার ভূমিকা নিয়ে ভারতের অন্যতম খ্যাতনামা লেখিকা শ্রীমতি অরুন্ধতী রায় বহুভাবে সোচ্চার হয়েছেন। এসব বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যদি কোনও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান তবে তাতে অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই। এর বাইরেও ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ আসামে এন আর সি কার্যকরী করতে গিয়ে সেখানে প্রায় চল্লিশ লক্ষ বাঙালি যাদের অধিকাংশই মুসলমান তাদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসাবে আখ্যায়িত করেন। তিনি তাদের ঠেলে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ঘোষণাও দেন। আসামের বাঙালিদের ঘুনে পোকা উল্লেখ করে তিনি এও ব্যক্ত করেন এরা ভারতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে খেয়ে ঠুনকো করে দিচ্ছে। এই ঘুনে পোকা বলা, এর মধ্যে একটি জাতি সত্তার প্রতি যে অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর অপমান করার অভিলাশ তা বাঙালি জাতিসত্তার অংশ হিসাবে আমাদের অহংবোধকে ভীষণভাবে আঘাত করে। এ আঘাতের প্রতিক্রিয়া হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসামের এন আর সি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সে সময়ে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন ‘অসমের অসভ্যতা বন্ধ করা হোক’। ঐ একই আলোচনায় আমি বাবরী মসজিদ প্রসঙ্গও তুলেছিলাম।
২২ জানুয়ারি ২০২৪ বাবরী মসজিদের স্থলে নির্মিত রাম মন্দির ব্যাপক দজ্ঞ যজ্ঞ এবং ঘটা করে উদ্বোধন করার পর পুরা বিষয়টি আজ আবার আলোচনার দাবী রাখে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান।
বাবরী মসজিদ। ১৫২৮ সালে মোঘল সম্্রাট বাবরের সেনাপতি ‘বাকী’ কর্তৃক নির্মিত। মসজিদটির অবস্থান উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এ মসজিদটি রামের কল্পিত জন্মভূমির উপর নির্মাণ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার অমর কবিতা ‘ভাষা ও ছন্দ’ তে অপূর্ব দ্যোতনায় উল্লেখ করেছেন–
‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি
ঘটে যা তা সব সত্য নহে কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো’
রাজনীতি এ সত্যকে ধারণ করেনি। কবি গুরুর এ কথা কে শুনে। বি জে পি’র হিন্দুত্ববাদ কায়েম করে ক্ষমতারোহন যখন মূল লক্ষ্য।
১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কয়েক হাজার সদস্য বাবরী মসজিদ ভাঙে। ড. আম্বেদকর – মহাত্বা গান্ধীর স্বপ্ন সমাধির উপর লক্ষ হিন্দু–মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লিপ্ত হয়। কয়েক হাজার মানুষ সেই দাঙ্গায় নিহত হয়। নিরাশ্রয় হয় আরো বহু সংখ্যক মানুষ। এর ঢেউ ধর্ম নিরপেক্ষ আমাদের দেশেও আচড়ে পড়ে। সাম্প্রদায়িকতা আমাদের এই অঞ্চলেও মাথা চাড়া দেয়।
বাবরী মসজিদ ইস্যুটি আদালতে গড়ায়। এ প্রেক্ষাপটে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এক রায়ে উল্লেখ করে, মসজিদটি রামের জন্মস্থানের উপর গড়ে উঠেছে। সুতরাং পাহাড় চূড়ায় রাম মন্দির নির্মিত হবে। মসজিদ নির্মাণের জন্য মোট জমির এক তৃতীয়াংশ ছেড়ে দিতে হবে।
হিন্দু–মুসলমান উভয় পক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে।
২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে বাবরী মসজিদের পুরা পৌনে তিন একর জমি রাম মন্দির নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দানের নির্দেশ দেয়। একই রায়ে উত্তর প্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডকে মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫ একর জমি বরাদ্দের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। সরকার এই আদেশ অনুযায়ী মূল বাবরী মসজিদ থেকে প্রায় ৩০ কি. মি. দূরে ধানিপুর নামক জায়গায় নতুন মসজিদের জন্য জায়গা বরাদ্ধ দেন। কী দুর্ভাগ্য মানবতাবাদী আম্বেদকর আর অহিংস গান্ধীর ভারতে মসজিদ–মন্দির পাশাপাশি থাকতে পারল না। হিন্দু–মুসলমানও। রাজনীতির এমনই করাল থাবা।
২২ জানুয়ারি ২০২৪ অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের ভগ্ন স্ত্তূপের উপর নির্মিত রাম মন্দির উদ্বোধন করতে গিয়ে শ্রী নরেন্দ্র মোদি ভগবান রামের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন প্রায় ৫০০ বছর তাকে আশ্রয় দানে অপারগতার জন্য। ভগবান বা স্রষ্টা কি এতই দুর্বল যে মানুষকে তাকে আশ্রয় দিতে হবে। স্রষ্টা কখনো আশ্রয়হীন হতে পারে না। সব মানুষের মাঝেই তো স্রষ্টার বাস। যে মানুষের মাঝে স্রষ্টার বাস সেই মানুষেরা বাবরী মসজিদ–রাম মন্দির দাঙ্গায় নিহত হন হাজারে হাজারে সেই মানুষদের পরিবারের কাছে এদিন নরেন্দ্র মোদি একবারও ক্ষমা চান নি। হতভাগ্য সেইসব মানুষদের রেখে যাওয়া স্বজনদের বেদনার কথা যাতনার কথা একবারও উল্লেখ করার গরজ অনুভব করেননি তিনি।
রাজনীতির ভগবান এমনিভাবেই হয়ত যুগে যুগে মানুষের রক্তের উপর প্রতিষ্ঠিত হন। ভারত আজ বাবরী মসজিদ–রাম মন্দিরে বিভক্ত। এ বিভক্তি বিভাজন থেকে ভারতকে রক্ষায় কংগ্রেস নেতা শ্রী রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়’ আন্দোলন শুরু করেছেন, সাথে বোন প্রিয়ংকাকেও সঙ্গী করেছেন। ভারত কতটুকু জোড়া লাগবে তা ভবিষ্যৎ এর গর্ভে।
২২ জানুয়ারি ২০২৪ ভারত সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি ঘটা করে অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির উদ্বোধন করেন। এই একই সময়ে অযোধ্যা থেকে প্রায় ৯২১ কি. মি. পূর্বে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায় সর্ব ধর্মীয় সম্প্রীতি শোভাযাত্রা বের করেন।
এক সময়ের ভারতীয় পররাষ্ট্র সচীব শ্রী স্যাম শরন, তিনি মায়ানমারে যখন রাষ্ট্রদূত তখন আমি ঐ দেশের সিটওয়েতে আমাদের মিশন প্রধান। সেই সূত্রে আমার শ্রী স্যাম শরন সাথে একটি উঞ্চ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সম্প্রতি তিনি চমৎকার একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম ‘ঐড় িওহফরধ ঝববং ঞযব ডড়ৎষফ –কধঁঃরষুধ ঞড় ২১ংঃ ঈবহঃঁৎু বইটির এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছেন ‘In Creation India has spread colors sound and flavours and local genius in South East Asia created their own’ অর্থাৎ সৃষ্টিতে–নির্মাণে ভারত রং, সুর আর সুবাস ছড়িয়েছে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রতিভাবানরা এ থেকে নিজ নিজ সৃষ্টি আর নির্মাণে নিজেদের যুক্ত করেছেন। এ অভিজ্ঞানের আলোকে এখন হয়ত সময় এসেছে ভারতীয়দের অবস্থান বিবেচনার।
ভারতীয় সাংবাদিক ‘Betwa Sharma’র সম্প্রতি রাম মন্দির নিয়ে লেখার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি।
‘If you celebrate while some one else in pain, something is broken in our society. We feel hopeless and cheated’ এ কথার মর্মার্থ–
‘কারো বেদনার উপর তুমি যখন উৎসবে মত্ত তখন বুঝে নিতে হবে আমাদের সমাজের কোথাও ভাঙ্গন ধরেছে। এ থেকে বঞ্চনা আর আশাহীনতা আমাদের পেয়ে বসেছে’।
লেখক: কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।