সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ at ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

অগ্নিগর্ভ মনিপুর : কুকনালিম!

আজকে এ লেখায় মণিপুরের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব। মনিপুর প্রধানত একটি পাহাড়ী অঞ্চল। মনিপুরের ৮০ শতাংশ পাহাড়ী অঞ্চল বাকি ২০ শতাংশ উপত্যকা। এই রাজ্যের ৬০ টি বিধান সভার আসনের ৪০টি মেইতি আর বাকি ২০ টি পাহাড়েরর খুকিদের জন্য নির্দিষ্ট।

মনিপুরের কথা উঠলেই প্রথমেই আমাদের সামনে আসে মণিপুরি নৃত্য। যা মনিপুরের সংস্কৃতি আর জীবনধারার যুগ যুগের ঐতিহ্যের পরিচায়ক। অমন সংস্কৃতির ফল্গুধারার মনিপুর এখন সংঘাত সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত। হানাহানি আর রক্ষপাত মনিপুরে এখন নিত্যদিনের দৃশ্যকল্প। মণিপুর নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিও এখন সরগরম। মণিপুরে বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসা সংঘাত বর্তমানে আরো তীব্রতর রূপ ধারণ করেছে। মেইতি আর খুকিদের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখানে এক পক্ষের নারীদের অপর পক্ষ উলঙ্গ করে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজারো মানুষের সামনে দিয়ে রাস্তা প্রদক্ষিণ করিয়েছে। নারীদের সম্ভ্রম হরণ করে হত্যা করতেও মনিপুরের মানুষ আর দ্বিধা করছে না।

এরই ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি মণিপুরের তিনটি জেলায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। মণিপুরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জন্য যা সবচেয়ে শংকার তা হল হামলায় সশস্ত্রগোষ্ঠী গুলির ড্রোনের মত অস্ত্রসস্ত্র ব্যবহার করা। মনিপুরের বর্তমান অবস্থা আলোচনার পূর্বে মনিপুরে ঘটে যাওয়া অতীত কিছু প্রসঙ্গ এখানে তুলে ধরা বাঞ্ছনীয়।

মনিপুর পিপলস লিবারেশন আর্মি। সত্তর এর দশকে নাগাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে মণিপুরের রাজকুমার মেঘান সার্বভৌম মণিপুর গঠনের লক্ষ্যে গঠন করেন “পিপলস রিভোলিউশনারী পার্টি অব কাঙলাইপাক”(প্রিপাক)। রাজকুমার মেঘানের আন্দোলন বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি মিশে যান ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোতে।

স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক মণিপুর গঠনের লক্ষ্যে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে বিশ্বেসর সিং এর নেতৃত্বে মনিপুর লিবারেশন আর্মি গঠিত হয়। মণিপুর লিবারেশন আর্মি তার জন্মের শুরু থেকেই তিব্বতের রাজধানী লাসায় চীনের পিপলস আর্মি এবং মায়ানমারে নাগা ন্যাশানাল কাউন্সিল কর্তৃক সামরিক প্রশিক্ষণের সুবিধা লাভ করে। মণিপুর পিপলস লিবারেশন আর্মি তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীকে নির্দিষ্ট করে। আশির দশকের ভারতীয় বাহিনীর হাতে পিপলস লিবারেশন আর্মির নেতৃস্থানীয় বিশেষ করে দলের প্রধান টি কুঞ্জবিহারী নিহত এবং বিশ্বেসর সহ অনেকে গ্রেফতার হলে পিপলস লিবারেশন আর্মির কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়ে এতদসত্ত্বেও পিপলস লিবারেশন আর্মি ১৯৮৯ সালে তাদের রাজনৈতিক শাখা গঠন করে। এ রাজনৈতিক শাখার নামকরণ করা হয় রিভোলিউশনারী পিপলস ফ্রন্ট বা সংক্ষেপে আর পি এফ।

বিশ্বেসর তার আন্দোলন গড়ে তোলেন মাও’ এর আদর্শকে ধারণ করে। তিনি ডঃ ফিজো, লালডেঙ্গার মত নেতার উপস্থিতিকে অনেকটা অবজ্ঞার অন্তরালে রেখে গোটা নাগাল্যান্ড মিজোরাম এবং মণিপুরে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার ডাক দেন। বিশ্বেসর তার কমরেডদের পকেটে পকেটে পুরে দেন মাও’য়ের লাল বই। প্রবল প্রতীতিতে বিশ্বেসর তখন প্রচার চালাচ্ছিলেন পুবের প্রবল হাওয়া পশ্চিমকে তছনছ করবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে কঠোর দৃষ্টিতে দেখেন। ১৯৮০ সালে বিশ্বেসর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হন। দীর্ঘ কারাভোগের পর বিশ্বেসর মুক্তি পান। মুক্তির পর বিশ্বেসর আর সমাজতন্ত্রমুখী হননি।

এরপরও মনিপুরের সাধারণ মানুষের মন থেকে বঞ্চনার বেদনা কখনো তিরোহিত হয়নি। বরং বেড়েছে নানা উপলক্ষঅনুষঙ্গকে সঙ্গী করে। মনিপুরীদের প্রতি ভারত সরকারের দীর্ঘ দিনের অবহেলা, নিপীড়ন আর বঞ্চনা থেকে মনিপুরীরা অস্ত্র হাতে বিদ্রোহের দাবানল জ্বালিয়ে দেয়।

সংগঠিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে মনিপুর পিপলস লিবারেশন আর্মি কখনো সহিংস কখনো অহিংস কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসে।

এরই প্রমাণ ৪ জুন ২০১৫ সন্ধ্যায় ৬ ডোগরা রেজিমেন্টের কনভয়ের উপর এক গুপ্ত হামলায় ২০ জনকে হত্যা এবং ১১ জনকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এ হামলা সংঘটিত হয় মণিপুরের পার‌্যালং এবং চারং এলাকার রাস্তা জুড়ে। এ হামলায় হামলাকারীরা অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ব্যবহার করে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের ধারণা নাগা ন্যাশন্যাল কাউন্সিলের (কাপল্যাঙ) সহযোগিতায় এ হামলা পরিচালিত হয়েছে। বিগত এক দশকের মধ্যে এটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর সবচেয়ে মারাত্মক হামলা।

মনিপুর বর্তমানে জাতিগত সংঘাতে জ্বলছে। এ সংঘাত সংঘর্ষের পিছনে ইন্ধন যুগিয়েছে মেইতি এবং খুকি আর নাগাদের ভূমি বিরোধ। বিরোধের উৎপত্তি যেভাবে। একটি রিট পিটিশানের ভিত্তিতে ১৪ এপ্রিল ২০২৩ মনিপুর হাইকোর্ট মনিপুর রাজ্য সরকারকে একটি আদেশ প্রদান করেন। ঐ আদেশে মনিপুর রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মেইতিদের ও সিডিউল ট্রাইবের মর্যাদা/ অধিকার প্রদানের সুপারিশ করতে বলা হয়।

পাহাড়ের খুকিরা এই আদেশে বিপদের গন্ধ খুঁজে পান। এই আদেশের বিরুদ্ধে “অল ট্রাইভেল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন” ৩ মে ২০২৩ রাজ্যজুড়ে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা বের করে। চুরাচানপুর এবং বিঞ্চপুর জেলায় এরকম দুটি শোভাযাত্রার উপর মেইতিরা আক্রমণ করে বসে। এথেকে শুরু হয় মেইতি আর খুকিদের মাঝে দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ আর হত্যাকান্ডের মত নারকীয় ধ্বংস যজ্ঞ। এ ঘটনার পূর্বেও দুটি জনগোষ্ঠীর মাঝে ভুলবুঝাবুঝি/ দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছিল। খুকিদের অভিযোগ ছিল কর্তৃপক্ষ এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী মেইতিদের হয়ে কাজ করছে, ভূমি জরিপের নামে তাদেরকে ক্রমশ তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অন্যদিকে মেইতিদের শংকা আর অভিযোগ ২০২১ সালে মায়ানমারে সামরিক অভ্যূত্থানের জেরে সেদেশের সাগাইঙ ডিভিশন এবং চিন স্টেট থেকে দলে দলে খুকিরা মনিপুরে আশ্রয় নিচ্ছে, এর ফলে মেইতিরা নিজেরা রাজ্যে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর আশংকা অনুভব করেন। পরস্পরের এই সন্দেহ অবিশ্বাস ক্রমশ মনিপুরে দুটি গোষ্ঠীকে সশস্ত্র রূপ ধারণ, একে অপরকে নিঃশেষ করায় মত্ত করেছে।

মনিপুরের চলমান সংঘাত সংঘর্ষে ভারত নিশ্চিতভাবে তার উত্তরপূর্ব ভারতের সর্া্বিক নিরাপত্তা নিয়ে উৎকন্ঠিত। ইতিমধ্যে সেপ্টেম্বর ২০২৪ এর শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন স্থানীয় এবং ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মায়ানমারের চিন স্টেট থেকে প্রায় ৯০০(নয় শত) প্রশিক্ষিত সশস্ত্র কুকি যোদ্ধা মনিপুরে প্রবেশ করেছে।

মনিপুর মিজোরাম হয়ে বাংলাদেশের সাথেও সম্পৃক্ত। আমাদের বান্দরবানে কুকিদের অবস্থান বর্তমান। সম্প্রতি নানা উৎপাত আর উপদ্রবের মাধ্যমে কুকিরা সেটা জানান দিয়েছে। বান্দরবানের কুকিদের সাথে মিজোরামের কুকিদের নিশ্চিত যোগাযোগ রয়েছে, মিজোরামের কুকিদের সাথে মনিপুরের কুকিদের নিবিড় সম্পর্ক থাকলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই।

এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে সম্প্রতি লন্ডনস্থ আই আই এস এস (ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ) উত্তর পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভারতবাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের কিছু মতামত তুলে ধরেছে, যা এখানে প্রণিধানযোগ্য। তাদের অভিমত বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে তিরোধানে উত্তরপূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে আই আই এস এস ভারতকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আই আই এস এস তাদের মন্তব্যে আরো উল্লেখ করেছে দু দেশের সুসম্পর্ক পুরা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

মনিপুরের সাধারণ নিগৃহীত নিপীড়িত মানুষের কথায় আসি। সহজ সরল এইসব মানুষেরা ক্ষেতে খামারে পাহাড়ে অনবরত পরিশ্রম করে জীবন ধারণ করে যাচ্ছে। মনিপুরের সাধারণ মানুষ তারা মেইতিও না কুকিও না আবার নাগাও না মিজোও না তারা শুধুই মানুষ। তাই তারা মনিপুরকে নিয়ে হৃদয় ছোঁয়া উচ্চারণ করেন “কুকনালিম” মনিপুর দীর্ঘজীবী হোক। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধAI এবং H2H মার্কেটিং, আচরণগত বিজ্ঞান এবং জাতিসংঘ ২.০ যুগের সূচনা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে পশ্চিম গহিরা পঞ্চবিহারে উপহার সামগ্রী বিতরণ