১ এপ্রিল ২০২৪ ইসরাইল দামেস্কস্থ ইরানের কনস্যুলেট আক্রমণ করে। সেই আক্রমণে ইরানের ইসলামী রেভ্যূলুশনারী গার্ডের কুদস ব্রিগেডের দুজন গুরুত্বপূর্র্ণ কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং তার ডেপুটি জেনারেল মোহাম্মদ হাদিসহ সাতজন সেনা সদস্য নিহত হন। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সমস্ত রীতিনীতি বিরুদ্ধ। ইরান বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয় এমনকি ঘটনাটির নিন্দা জানাতেও। অথচ জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে Article 51 of the Charter thus Recognizes the existence of an inherent right of self defence in the cage of an armed attck by one State against another State. অর্থাৎ জাতিসংঘ সনদ ৫১ ধারা বলে কোন একটি দেশ কর্তৃক অন্য একটি দেশ সামরিক আক্রমণের শিকারে পরিণত হয় তবে আক্রান্ত দেশ স্বভাজাতভাবেই প্রতি আক্রমণের অধিকার সংরক্ষণ করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরে অন্য একটি দেশের এবং আরো একটি সার্বভৌম দেশের কূটনৈতিক মিশনে সামরিক অভিযান পরিচালনায় নিন্দা জানাতে ব্যর্থতা শুধু জাতিসংঘের অকর্মন্যকেই তুলে ধরে না বরং আক্রান্ত দেশগুলিকে প্রতিক্রিয়া এবং প্রতি আক্রমণ চালাতেও বাধ্য করে।
ইতিপূর্বে ৩ জানুয়ারি ২০২০ বাগদাদে ইরানি কুদস বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে আমেরিকানরা ড্রোন হামলার মাধ্যমে হত্যা করে। প্রতিশোধ নিতে ইরান ইরাকের বিভিন্ন আমেরিকান সেনা ছাউনিতে মিসাইল হামলা চালিয়ে ১১০ জন মার্কিন সেনাকে আহত করে।
১ এপ্রিল ২০২৪ দামেস্কস্থ ইরানি কনস্যুলেট আক্রমণের পর থেকে ইরান ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এরই ফলশ্রুতি ১৩/১৪ এপ্রিল ২০২৪ ইরান ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ৩০০ ড্রোন, ক্ষেপনাস্ত্র এবং ব্যালেস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করে।এ সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের অধিকাংশই লক্ষ্যবস্ত্তুতে আঘাত হানার পূর্বে আমেরিকান, যুক্তরাজ্য, জর্ডান এবং ইসরাইলী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়। অবিশ্বাস্য হল যে জর্ডানের বিশাল ভূ–খণ্ড ইসরাইলের দখলে সে জর্ডান ইরানী ক্ষেপনাস্ত্র ধ্বংসে ইসরাইলের হয়ে অংশ গ্রহণ করে। আরো অবিশ্বাস্য হল ইরান ইসরাইলের উপর আঘাত হানার বিষয়টি আগেভাগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিকে অবহিত করে। অবহিত করার কারণ হল তারা যেন তাদের আকাশ পথে নিরাপদ থাকে কিন্ত্তু অবহিত হয়ে বিষয়টি ইউ এ ই এবং সৌদি আরব দ্রুততম সময়ে আমেরিকাকে তা জানিয়ে দেয় এবং আমেরিকা আরো তড়িৎ ইসরাইলকে। ফলাফল আক্রমণ প্রতিরোধে ইসরাইল, আমেরিকার নৌ বহর, যুক্তরাজ্যের যুদ্ধ বিমান আর জর্ডানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পূর্ব প্রস্ত্তুতি এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে ইসরাইলের রক্ষা পাওয়া।
কী নিদারুণ নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি এখন পশ্চিমের মুখোশ পরা সভ্যতা। বিগত ৬ (ছয়} মাসেরও অধিক সময় ধরে কোন প্রকার আকাশ প্রতিরক্ষাবিহীন গাজার উপর প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে অবিরাম ইসরাইলী বোমাবর্ষনের প্রতিকারে কোন একটি পাশ্চাত্য সভ্য দেশকি একটি যুদ্ধ বিমানও পাঠিয়েছে। বরং আমেরিকা, বৃটেন, জার্মানী, ফ্রান্স ক্রমাগত ইসরাইলকে সমরাস্ত্র পাঠিয়ে যাচ্ছে গাজায় আরো বেশী মানুষ হত্যায়।
বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে ইরানী এই আক্রমণ প্রতিরোধে ইসরাইলকে ১৩৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। ইতিমধ্যে আমেরিকা ইসরাইলের উপর ইরানী আক্রমণের ব্যাপারে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, ইসরাইলের নিরাপত্তা সুরক্ষায় তাদের অবস্থান “আইরনক্লেড” বা লৌহকঠিন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরের মত ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে ইরানের পদক্ষেপকে নিন্দা জানিয়েছে। রাশিয়া, চীন, এবং উত্তর কোরিয়া সতর্ক অবস্থান নিয়েও জানান দিয়েছে তারা ইরানের পক্ষে।
হামলার পরদিনই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে বসে সকল পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। অথচ ১ এপ্রিল ২০২৪ দামেস্কের ইরানী কনস্যুলেট আক্রান্ত হওয়ার পর এমনটি দেখা যায়নি এমনকি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। এ থেকে জাতিসংঘের মোড়লদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট। এরপরও এরই মধ্যে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘোষণা এসেছে আমেরিকার পক্ষ থেকে। এ ঘোষণায় আমেরিকা যা বলেছে তা হল ইসরাইল ইরানী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানে কোন ধরনের পাল্টা হামলা চালাতে গেলে আমেরিকা তাতে কোন প্রকার অংশ নেবে না। ইউক্রেন যুদ্ধ হয়ত আমেরিকাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে থাকতে পারে। তবে নিশ্চিতভাবে এ বার্তাটি ইসরাইলী “ওয়ার ক্যাবিনেট”কে ইরানী আক্রমণের তড়িৎ এবং পাল্টা আক্রমণে দ্বিধাবিভক্ত করেছে।
ইসরাইলীদের গাজায় ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে অমানবিক অভিযান ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী নিন্দা, ঘৃণা আর প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। সেদিক থেকে ইসরাইলীরা এক প্রচন্ড মনস্ত্তাত্বিক চাপে রয়েছে। এ চাপ সামলিয়ে ইসরাইলীরা ইরানের সাথে গাজার বাইরে গিয়ে আরো একটি বড়সড় পরিসরে যুদ্ধে জড়ালে তা বিশ্ব পরিমন্ডলে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে নিশ্চিতভাবে। ইতিমধ্যে ইসরাইলের মূল মদদ দাতা আমেরিকা ইউক্রেন যুদ্ধে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি। রাশিয়ার তুমুল আক্রমনে ইউক্রেন এখন দিশেহারা। ইউক্রেনের ইউরোপিয় পৃষ্ঠপোষকরাই এখন ক্রমান্বয়ে ইউক্রেনের দিক থেকে মুখ ফিরাচ্ছে এবং কেউ কেউ ইউক্রেনের পতন সময় গোনা শুরু করেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলনস্কি মরিয়া হয়ে এখন প্রকাশ্যে বলতে বাধ্য হচ্ছেন তার সেনাবাহিনীর রাশিয়ান আক্রমণ ঠেকাতে সামরিক সরঞ্জাম ফুরিয়ে এসেছে।
বিবেকবান যে কোন মানুষ বেদনার্ত হয়ে বর্তমানে প্রত্যক্ষ করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি গাজায় ৩৪,০০০(চৌত্রিশ হাজার) মানুষের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড যার মধ্যে ১৪০০০ (চৌদ্দ হাজার) হাজারেরও বেশী শিশুর হৃদয়বিদারক মৃত্যু দেখেও, ৭৪,০০০ (চুয়াত্তুর হাজার) আহত মানুষের আহাজারির শব্দ শুনেও তাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কোন রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে তারা হয়ত অপারগ অথবা নির্বিকার। আমি নিশ্চিত মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলি পাশ্চাত্যের তাবেদার হলেও সাধারণ আরবরা নন এবং এখন দেখার বিষয় হবে আগামী দিনগুলিতে মধ্যেপ্রাচ্যের সরকারগুলি কিভাবে সেসব দেশের জনমত বা জনরোষকে সামাল দেয়। এ বিষয়টি এখন সামনে আসছে। কিছুদিন আগে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া মধ্যপ্রাচ্যের এক ইমাম সাহেবের সংক্ষিপ্ততম এই খোতবা তারই ইঙ্গিত বহন করে। তার বয়ান ছিল “ত্রিশ হাজার নিরীহ মানুষের নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, পঁচাত্তুর হাজার আহত মানুষের আহাজারিও যে উম্মাহকে জাগাতে পারেনি সেখানে আমার মত একজন ক্ষুদ্র ইমামের এই বয়ানই বা আপনাদের কি ভাবে জাগাবে” বলেই ইমাম সাহেব আর কোন কথা না বলে বসে পড়েন। এ থেকেই অন্যায়ের প্রতি আরব উপদ্বীপের সাধারণ মানুষের দ্রোহ আর বেদনা ফুটে উঠে।
ইতিমধ্যে ইসরাইলী ‘ওয়ার ক্যাবিনেট’ প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করে চলেছে। তারা হয়ত ইরান আক্রমণ করার সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এক্ষেত্রে ইরানের পারমানবিক স্থাপনা সমূহ ইসরাইলের লক্ষ্যবস্ত্তু হতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইরান সমস্ত পারমানবিক স্থাপনার কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। ইসরাইল যদি সত্যিই ইরানে হামলা চালায় তবে তা বিশ্ব পরিস্থিতি ওলট পালট করে দেবে। এ রকম কিছু ঘটলে তা সামরিক সংঘাতের মাধ্যমে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করবে একইভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকেও বিপর্যযের মুখে ঠেলে দেবে। এরই মাঝে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি গাজায় ফিলিস্তিনি যুদ্ধরত তথা হামাসের সাথে সংহতি জানাতে লোহিত সাগরে হুতিরা পন্যবাহি জাহাজ সমূহের উপর আক্রমন পরিচালনা করছে। এই আক্রমণের ভয়ে জাহাজ সমূহকে ঘুর পথে যাতায়াত করতে গিয়ে বেশী ভাড়া গুনতে হচ্ছে, এ অবস্থায় পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে অনেকগুণ যা শেষাবধি সাধারণ ভোক্তা শ্রেণীকেই বহন করতে হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য যৌথভাবে হুতিদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে এতে এখনও পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং ঝুঁকির পরিমাণ আরো বেড়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে যদি ইসরাইলীদের দ্বারা ইরান আক্রান্ত হয় তবে নিশ্চিতভাবে ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করায় উদ্যোগী হবে এতে বিশ্বে জ্বালানী তেল সরবরাহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। আমাদের মত জ্বালানী তেল আমদানী র্নিভর দেশগুলির অর্থনীতি তখন নাজুক এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
গাজায় ইসরাইলীদের দ্বারা ইতিহাসের জঘন্য এবং বর্বরতম গণহত্যার বিরুদ্ধে ইরানের বর্তমান দৃঢ় অবস্থানকে ইসরাইলের মদতদাতারা কখনো ভাল চোখে দেখেনি। এই না দেখার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসনাধীন দেশগুলির সামনে সবসময় একটি ইরানী জু জু তারা দাড় করিয়েছে তার একটি হল ইরান প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলে তাদের ক্ষমতা বিপর্যস্ত হবে। দ্বিতীয়ত শিয়া–সুন্নী বিষয়টিকে সামনে এনে পশ্চিমারা ইসলামী বিশ্বকে সবসময বিভক্ত করার পায়তারা করে এসেছে। একই কায়দায় তারা অটোম্যানদের বিরুদ্ধে একসময় আরবদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল, যার ফলাফল বালফোর ডিকা্লরেশন এবং পরবর্তীর ইসরাইলের সৃষ্টি।
পাশ্চাত্য গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদির কথা বলে বিশ্বব্যাপী তাদের মহত্ত প্রচার করে। অথচ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব পাশ হওয়া সত্ত্বেও তা কার্যকরী করতে পাশ্চাত্যের দেশগুলির তেমন কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে গাজায় নারী পুরুষ শিশুর মৃত্যু দেখেও নির্বিকার পশ্চিমা সভ্যতার মুখোশ পরা অসভ্য বিশ্ব।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক