চতুর্থবারের মতো কন্যা সন্তানের চেহারা দেখে হাসতে পারাটা তখনকার দিনে বেশ শক্তই বলা যায়। যেখানে বাদ বাকী সবাই চিন্তিত, উৎকণ্ঠায় মুখ শুকিয়ে ফেলেছিলেন এই ভেবে যে, চারটি মেয়েকে পাত্রস্থ করা হবে কীভাবে? এটাই যেনো কন্যা সন্তান জন্মানোর পর ভাববার একমাত্র বিষয়। এইসব বিষয়কে তোয়াক্কা না করে যিনি হাসিমুখে চতুর্থবারের মতো বাবা হওয়াকে উদযাপন করেছেন তাঁর মতো করে, অবশ্যই হাসিমুখে। তিনি আমার বাবা।
কোনোদিন একটা পুত্রসন্তানের জন্য আফসোস না করা আমার বাবা সবসময় তাঁর মেয়েদের রাজকন্যার মতো করেই আগলে রেখেছেন, এখনো তাই চেষ্টা করে যান, তাঁর সামর্থের মধ্যেই।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর সে প্রচেষ্টায় কোনো ত্রুটি ধরা পড়লো না। তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁর ভালোবাসার নির্যাসটুকু আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন প্রতিনিয়ত। সাইকেলের পেছনে বসিয়ে গানের স্কুলে নিয়ে যাওয়া থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত তাঁর সময় আর শ্রম ঢেলেছেন আমাদের জন্য। তবে দিন শেষে তাঁর মেয়েরা তাঁকে কিছু দিতে পারেনি আজও। তাঁর মেয়েদের নিয়ে তাঁর গর্ব করার মতো কিছুই নেই। তবুও তিনি সন্তুষ্ট, আমাদের মতো সাদাসিধা জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা মেয়েদের নিয়ে। সবার কাছে তার বাবাই শ্রেষ্ঠ, তার বাবাই মহান, তার বাবাই যেনো পৃথিবীতে একজন মাত্র ভালো মানুষ। তাঁর স্থানটা এতটাই ওপরে।
আর বাবাকে নিয়ে আলাদা করে বলা যায় না কখনো, সাথে মায়ের প্রসঙ্গটা চলেই আসে। যেমনি করে মাকে নিয়ে আলাদা করে বলা যায় না, বাবার কথা প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসে। এরা একে অন্যের পরিপূরক। এদের একজনকে বাদ দিয়েও আমাদের জীবন পরিপূর্ণ হয় না কখনো। এটাই প্রকৃতি, এটাই জীবনের মূল অনুষঙ্গ। প্রত্যেক সন্তানের কাছে তার বাবা মা প্রতিদিনই বিশেষ মানুষ হিসেবে সম্মানিত হবে, এটাই প্রত্যাশা।
আমি আমার শ্বশুরকে জীবিতকালে পাইনি। তবে এতটুকু জানি তিনি বেশ সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। খুব সাদাসিধা জীবন ছিলো তাঁর। একটু সহনশীলতা আর কৃতজ্ঞতা বোধ যদি নিজেদের মধ্যে ধারণ করা যায়, তবে এটুকু বলা যায় কোনো বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। আমাদের সন্তানদের সাথে তাঁরাও না হয় বুড়ো খোকা খুকু হয়ে রইলো একসাথে। সহজ সরল জীবনে যা প্রয়োজন একসাথেই না হয় ভাগ করে নেবো, ক্ষতি কীসে? নয়তো বৃদ্ধাশ্রমে বাবা মায়ের পাশাপাশি যখন নিজেদের অবস্থান হবে, সেটাকে মেনে নিতে পারবো তো? প্রথম জীবনে একটু ভুলের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে বাবা মায়ের সাথে চোখাচোখি হলে জীবনের শেষ প্রসঙ্গের এই অনুশোচনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে লাভ কী!