‘পড়… পড়…জিপিএ ফাইভ না পেলে কোথাও টিকবি না। টাকা না থাকলে কোথাও দাম পাবি না।’…ক্যারিয়ার গঠনের এই ঘোড় দৌড়ে আমরা মানুষ হতে ভুলে যাই। ‘পড়ো, পড়ো …’ না বলে কেউ যদি ‘শেখো… শেখো…’ বলতো তাহলে হয়তো কিছু শেখাও হতো। আমরা পড়ি রোজ অনেক কিছু কিন্তু শিখি না। পড়া শেষ হয়, বছর শেষে পুরোনো বইয়ের বদল হয়, নতুন সার্টিফিকেট ঘরে আসে। কাগজে শুরু কাগজে শেষ – মগজে থাকে না। কেউ যদি বলতো একটু বুঝে শুনে পড় বাবা, তাহলে হয়তো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম হতো। কিন্তু এই ‘কেউ’ টা কোত্থেকে আসবে, চারিদিকে তো কেবল ‘কেউকেটা’! গাদা গাদা বই খাতা আর এ্যাসাইনমেন্টের ভিড়ে আমরা শিক্ষার মূল লক্ষ্যটাকে হারিয়ে ফেলেছি। কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন, ‘মানুষ হতে মানুষ আসে/ বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়,/ তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ / তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়!’ এই শিরদাঁড়া তৈরির যে মূলমন্ত্র শিক্ষা সেখানে যদি কোন কমতি থেকে যায় তাহলে শিরদাঁড়া কোনদিনও মজবুত হবে না। আমরা লক্ষ লক্ষ জিপিএ ফাইভ পাবো, কিন্তু একটা মজবুত শিড়দাঁড়ার মানুষ পাবো না। আমাদের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য, গুরুত্ব এবং বাড়তি পড়ালেখার চাপে শিক্ষার্থীরা জর্জরিত। ‘রিডিং ফর প্লেজার’ বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। পাঠ্য বইয়ের নিচে গল্প, উপন্যাসের বই রেখে চুরি করে বই পড়ার দিনগুলো আমরা হারিয়েই ফেলেছি। সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে ‘ডিভাইস’, ‘ইন্টারনেট’ যার ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক ব্যবহারেই ঝোঁকটা বেশি যার কারণে ঝুঁকিও বেশি। আমাদের নিত্যদিনের যাপিত জীবন পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবো খাদ্যাভ্যাস থেকে নিদ্রাভ্যাস সবকিছুতেই খানিকটা বদভ্যাস নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়েছে। এই পরিণতির জন্য আমরা কখনো টিভি চ্যানেলকে, কখনো মোবাইল ফোনকে, কখনো ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে দোষারোপ করি। একটু সহজভাবে যদি বলি যে চাল দিয়ে বিরিয়ানী তৈরি করা যায়, সে চাল দিয়ে ভাতও রান্না করা যায়। কী রান্না করা হবে সেটা কিন্তু আমার রুচির উপর নির্ভর করে। আমি টিভিতে কী দেখবো, ইন্টারনেটকে কী কাজে ব্যবহার করবো তা আমার নিজের রুচি, পছন্দ এবং ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। দিনশেষে আমাদের সবার হাতেই চব্বিশ ঘণ্টা। এই চব্বিশ ঘণ্টা টিভির রিমোট দিয়ে খরচ করবো, নাকি ইন্টারনেট ডিভাইস দিয়ে খরচ করবো, নাকি ভালো কোন চর্চা বা অভ্যাসে ব্যয় করবো সেটার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকা উচিৎ। যদি টিভির রিমোট আমাকে কন্ট্রোল করে, ইন্টারনেট ডিভাইস আমার উপড় ছড়ি ঘোরায় তাহলে আমার মানুষ হয়ে জন্ম নেয়া বৃথা। আমরা নৈতিকতার অবক্ষয়, সামাজিকতার অবক্ষয় ইত্যাদির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবো না। কারণ এই সমাজের একক হলো মানুষ, সব ধরণের সমস্যার এককও মানুষই। মানুষ যদি ঠিক হয় তাহলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা পৃথিবী ঠিক হবে। মানুষই এসবের মূল চালিকাশক্তি আর সেই মানুষ ঠিক করার চাবিকাঠি হলো সঠিক শিক্ষা।