চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বিশেষজ্ঞ কমিটি আগামী বর্ষায় নগরে জলাবদ্ধতা সহনীয় রাখতে ৮ দফা করণীয় ঠিক করেছে বলে জানা গেছে। গত ২০ মার্চ দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, শহরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জলাদ্ধতাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে নির্ধারিত এসব করণীয়’র মধ্যে আছে ১০টি খাল খনন ও ৯টি খালের মুখ পরিষ্কার, আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডের বক্স কালভার্ট পরিষ্কার, চারটি খালসংলগ্ন স্থানে সিল্ট ট্র্যাপ (বালি আটকানোর ফাঁদ) নির্মাণ, বারইপাড়া ডাইভারশন চ্যানেলে সংস্কার, খালে ভাসমান প্লাস্টিকসহ পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী ভাসমান পণ্য আটকে তুলে ফেলা ও স্লুইচ গেট সংস্কার।
গত বুধবার টাইগারপাস চসিকের সম্মেলন কক্ষে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জলাবদ্ধতা নিরসন বিষয়ক সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে করণীয়গুলো তুলে ধরে চসিক, সিডিএ, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে আগামী ৩০ মে–এর মধ্যে বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন চসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত অস্ট্রেলিয়ায় ড্রেনেজ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ড. আবদুল্লাহ আল মামুন।
এ সময় সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, জলাবদ্ধতা একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা কেবল সিটি কর্পোরেশনের একক প্রচেষ্টায় সমাধান সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্নভাবে কাজ করছি। অভিজ্ঞদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য চট্টগ্রামের ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও জলধারণ সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। আমরা চাই প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হোক এবং তা কার্যকর হোক। এজন্য পরিকল্পিত ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
ড. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মেয়রের অনুরোধে অস্ট্রেলিয়ার কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে মার্চে চট্টগ্রামে এসেছি। এই সময়ে নগরের খাল, নালা, নর্দমাগুলো ঘুরে দেখেছি এবং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। এর ভিত্তিতে জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প মেয়াদে করণীয় নির্ধারণ করেছি। তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে টেকসই পরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, সেতু ও রেলওয়েবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অল্প কয়েকদিন আগে এক লেখায় লিখেছিলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ দুটি–এক. নির্বিচার পাহাড় কাটা; দুই. খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। পাহাড় কাটার কারণে একদিকে ঢালু জমি সমতল হওয়ায় পানি আটকে থাকছে। আবার পাহাড়ের বালু খালের তলদেশে জমা হয়ে খালের গভীরতা কমাচ্ছে এবং বৃষ্টি ও বন্যার পানি অপসারণের ক্ষমতা হ্রাস করছে। এ ছাড়া খালের বিএস সীমানার ভেতরে অবৈধ ভবন নির্মাণ করায় এটির প্রশস্ততা কমে বৃষ্টি ও বন্যার পানি অপসারণের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সর্বশেষ কারণটি হলো, নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবনতি। ড্রেনগুলো আবর্জনা খালগুলো ভরাট করে ফেলেছে। বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে সর্বনাশা হলো পলিথিন ব্যাগ ও পিইটি বোতল। পরিদর্শনকালে আমরা দেখতে পাই, খালের উপরিভাগ এসব বর্জ্যে ছেয়ে আছে। ওপরের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট ও প্রকৃতির প্রতিশোধ। তাই এটা মোকাবিলায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নগরীর বাসিন্দাদের পাহাড় ও খালখেকোদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ ও পিইটি বোতলের পরিবর্তে কাচের জগ ব্যবহার করতে হবে। না হলে বর্তমানে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয়িত প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের দ্বিগুণ বা তিন গুণ ব্যয় করলেও এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা আছে। দীর্ঘদিনের সমস্যা একদিনে সমাধান হবে না, কিন্তু সমাধান তো হতে হবে। সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় হতে হবে। বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে খাল খনন ও পরিষ্কারের কাজ শুরু করা হয়েছে বলে সিটি মেয়র জানিয়েছেন। সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গেও সুপারিশগুলো নিয়ে বসেছেন। আশা করছি, আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা সমস্যা একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যাবে।