সফল হলো প্রধানমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ

ডা. দুলাল দাশ | সোমবার , ২৭ জুন, ২০২২ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ


বহুদিন থেকে শুনে আসছি, মানুষের মুখে মুখে, ‘স্বপ্নের পদ্মাসেতু’। এটা এখন স্বপ্ন নয় শতভাগ বাস্তব। কারণ এটা ঘুমের স্বপ্ন ছিল না। এটা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সেই স্বপ্ন যে স্বপ্ন তাকে ঘুমাতে দেয়নি। পদ্মাসেতু আমাদের আবেগ, জাতীয় অহংকার, সাহস ও সক্ষমতার প্রতীক। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মাসেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন মাওয়া প্রান্তে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরীর জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা বহুমাত্রিক সেতু। এটা বাংলাদেশের আশীর্বাদ। এখানে ৪২টি স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভ বাংলাদেশের প্রতীক। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে স্বচ্ছতার সাথে তৈরী হয়েছে। এর পাইলিং ১২০ মিটার পর্যন্ত গভীরে। সেতুটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে ৭ বছর ৬ মাস ২৬ দিন। মোট খরচ হয়েছে ৩০১৯ কোটি টাকা।

এটা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয় সাশ্রয়ী স্থাপনা এবং দৃষ্টিনন্দন সেতু। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম পাইলিং এর উপর প্রতিষ্ঠিত। সেতুটির আয়ূষ্কাল ধরা হয়েছে একশত বৎসর। অতি আড়ম্বরপূর্ণ ও উভয় পাড়ের লক্ষ লক্ষ লোকের আনন্দেজ্জ্বল উপস্থিতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেতুটি ২৫ জুন, ২০২২ উদ্বোধন করলেন। সেতুটি চালু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার জনসাধারণের যাতায়াতের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ কেটে যাবে। সময়ের সাশ্রয় হবে, সুগম হবে যাতায়াত। সেতুর সড়ক ও রেল দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে। দিনের পর দিন, যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকগুলি ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় থাকবে না। ঝড়-বৃষ্টি তুফানের কারণে যাতায়াত থমকে থাকবে না। অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মারা যাবে না। ঢাকাবাসীকে ৬০-৭০ টাকায় বেগুন খেতে হবে না। সেতুটি উদ্বোধনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেল।

ইতিমধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের সমীক্ষায় বলছে মোট জনসংখ্যার পাঁচভাগের একভাগ অর্থাৎ ৩ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। প্রতি বছর দারিদ্র্য কমবে ৮৪%। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১:৩ শতাংশ। আঞ্চলিক জি.ডি.পি বাড়বে সাড়ে তিন শতাংশ। যেহেতু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ সহজ হবে ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। দেশি বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব কমবে। বছরে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪% অর্থাৎ ২ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হবে। দারিদ্রতা কমবে ০.৮৪%। অভাবগ্রস্ত মানুষদের জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদিত পণ্য আর পচবে না। কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবে। মংলা সমুদ্র বন্দর, পায়রা বন্দর, বেনাপোল ও ডোমরা স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ও হাইওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ ঘটবে। ভারত, চীন, নেপাল, ভূটান ও মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এটাকে ইন্ডাসট্রিয়েল করিডোর হিসাবে ব্যবহার করা হবে।

সরকার পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে পদ্মার দুই পাড়ে গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, শেখ হাসিনা তাঁত শিল্প, আঞ্চলিক ভিলেজ, হাইটেক পার্ক, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, খুলনা বরিশাল জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রসারিত হবে। আরও অনেক মেগা প্রকল্প গড়ে উঠবে। বিসিক বলছে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বরিশালে ৫০০-১০০০ হাজার নতুন শিল্প কারখানা স্থাপিত হবে। এখন দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে ভিড় বাড়বে। অল্প সময়ে সহজ পথে ঘুরে আসা যাবে। পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে যেমন জাতির পিতার সমাধিসৌধ, সাগর কন্যা কুয়াকাটা, জীব বৈচিত্র্যের লিলাক্ষেত্র, ওয়াল্ড হেরিটেজ, সুন্দরবন, যশোরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি, লালন সাইজির মাজার কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্র কুঠি বাড়ি আরও অনেক।

পদ্মা প্রমত্তা বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী আমাজানের পরে। পদ্মা পাড়ের মাঝি মোল্লারা অসমসাহসের সাথে এটি পাড়ি দেয়। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ সিনেমা যেটাতে এপার বাংলা ও ওপার বাংলার শিল্পীরা অভিনয় করছে যারা দেখেছেন তারা জেনেছেন পদ্মার পারের মৎস্যজীবীদের জীবন জীবিকা সম্বন্ধে। থৈই থৈই পানি দুকূল চাপিয়ে যায়। এক কিশোরী তার বাবার সাথে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় যাচ্ছিল। পদ্মা নদী পার হতে হবে। মাঝ পথে হঠাৎ প্রচণ্ড দমকা বাতাস, সবাই ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। জামাকাপড় ভিজে গেছে। একটু পরে থেমে গেল। সেই মেয়ে এখন যুবতী। জানতে পারল বহুকালের স্বপ্নের পদ্মাসেতু আজ শেখ হাসিনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেছে। বলতেছে এখন ঢাকা ফরিদপুর সেতুর উপর দিয়েই আসা যাওয়া করব, কি মজা! এই সেতু বাস্তবায়ন একটা অভূতপূর্ণ ও অকল্পনীয় সফলতা। প্রাকৃতিকভাবেও একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। পদ্মার ভয়াল রূপ ফি বছর কত ধ্বংসলীলা চালায়।

এই পদ্মা নিয়ে লেখক, কবি, সাহিত্যিক কত প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘ও পদ্মার ঢেউরে…..। ইতিমধ্যে ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা পদ্মাসেতু নির্মাণে সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। চীনের রাষ্ট্রদূত বলিষ্ট কণ্ঠে শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন এটা কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল যেখানে বিদেশি অংশীদারিত্ব ছাড়া সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে সেতুটি নির্মিত হয়েছে। এখানে তিনটা জিনিস কাজ করছে যথা- সাহস, সংকল্প, রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেম। মি. লি. জিমির বলেন চিনের বাইরে এই কোম্পানী এই রকম সেতু আর করেন নি। সেতুটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার একটা কোম্পানীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সেতুর দুই পাড়ে সেতুর নিকটে গড়ে উঠবে ছোট ছোট শহর। পদ্মা যেহেতু বেশি অশান্ত ও খরশ্রেতা তাই অবিরাম সেতুটির মনিটরিং খুবই প্রয়োজন। এটা যেমন আমাদের গর্ব ঠিক আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো পোতাশ্রয়ে নির্মিত গোল্ডেন গেট ব্রিজ ছিল আমেরিকানদের অর্জিত শৌর্যবীর্যের প্রতীক। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই ব্রিজটা দেখার। আমাদের পদ্মা সেতু বিশ্বে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

আমাদের মহান নেতা যার বিচক্ষণতা ও উদারতার তুলনা নেই। অনেক সুপারিশ উপেক্ষা করে তিনি নিজের নামে সেতুটির নাম রাখেন নেই। তিনি মনে করেন এটা জাতীয় স্থাপনা। আমরা কেউই থাকব না, পরবর্তী বংশধর আসবে, অনন্তকাল ধরে পদ্মাসেতু সেবা দিয়ে যাবে আর মানুষের হৃদয়ে প্রজ্জলিত থাকবে বাংলাদেশের এককালের মহান নেত্রী শেখ হাসিনার পুণ্যস্মৃতি।

লেখক : প্রাক্তন চীফ এ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামী শিক্ষা বিস্তারে আলোকিত আমরা : একটি পর্যালোচনা
পরবর্তী নিবন্ধসড়ক-মহাসড়কের পাশে পশুর হাট বসানো যাবে না : স্থানীয় সরকার মন্ত্রী