সন্ধ্যার পর ছিনতাই ডাকাতি নিত্য ঘটনা

চকরিয়া রেল স্টেশন নামেই আধুনিক, নেই রেল পুলিশ ও লাইটিং

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া | শনিবার , ২১ জুন, ২০২৫ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার জেলা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের উন্নত, আধুনিক ও নিরাপদ ভ্রমণের যোগাযোগ ব্যবস্থায় শত বছরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে। বহুল প্রতীক্ষিত এই রেললাইন স্থাপনের পর সারাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় এতদঞ্চলের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। ২০২৩ সালের ১২ নভেম্বর কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের শতভাগ বাস্তবায়ন হলেও উপজেলা ভিত্তিক স্টেশনগুলোকে শতভাগ নিরাপদ করার কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি।

সরেজমিন দেখা গেছে, দিনের আলো গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই উপজেলা ভিত্তিক রেল স্টেশনগুলোর প্রত্যেকটাই যেন একেকটা অপরাধের স্বর্গরাজ্য। স্টেশনগুলোতে নেই কোনো লাইটিং ব্যবস্থা, নেই রেলওয়ে পুলিশও। এতে সন্ধ্যা নামতেই স্টেশনে আগত যাত্রীসাধারণ পড়ছেন ডাকাত, ছিনতাইকারীর কবলে। এ সময় সশস্ত্র ডাকাতছিনতাইকারীদের কাছে জিম্মি হয়ে সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি শারীরিকভাবেও হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে যাত্রীসাধারণকে। এতে স্টেশনগুলো একেবারে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

শুধুমাত্র সাহারবিলস্থ চকরিয়া স্টেশনের গত ছয় মাসের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে যে চিত্র পাওয়া যায় তা একেবারেই শোচনীয়। প্রতিনিয়ত এই স্টেশনে বেশুমার পর্যটক, যাত্রীসাধারণ অপরাধীদের কাছে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি হলেও সরকারের টনক নড়েনি। এগিয়ে আসেনি রেল স্টেশনগুলোতে যাত্রীসাধারণ চলাচল নিরাপদনির্বিঘ্ন করার উদ্যোগ নিতে।

ভুক্তভোগী ও স্টেশনের আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, চকরিয়ার স্টেশনটি এমন জায়গায় স্থাপিত হয়েছে, সেখানে রাতের বেলায় তো দূরের কথা, দিনের আলোতেও কোনো ধরনের নিরাপত্তা নেই যাত্রীসাধারণের। স্থানীয় টোকাইসন্ত্রাসীছিনতাইকারীডাকাতদের কাছে এই রেলস্টেশন যেন স্বর্গরাজ্য। চকরিয়া রেল স্টেশনটির এই পরিণতির কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়ে স্টেশন মাস্টার মো. ফরহাদ চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত ও শত বছরের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু এর একমাসের মধ্যেই উপজেলা ভিত্তিক স্টেশনগুলো যেন একেকটা অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিণত হতে থাকে। তবে রেলে ভ্রমণকারী পর্যটক ও যাত্রীসাধারণকে বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে চকরিয়া স্টেশন অতিক্রম করার সময়। এই স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীসাধারণকে প্রতিনিয়ত ডাকাত, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী ও টোকাইদের খপ্পড়ে পড়ে সর্বস্ব হারাতে হচ্ছে। এমনকি শারীরিকভাবেও হেনস্থার শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ।

এই সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পেছনের কী কারণ রয়েছে, এমন প্রশ্নে সাহারবিল স্টেশন মাস্টার ফরহাদ চৌধুরী জানান, বর্তমানে এই রেলওয়ে স্টেশনটিতে যাত্রীসাধারণেরা কয়েকটি নিরাপত্তাজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তদ্মধ্যে সন্ধ্যা পরবর্তী রেলওয়ে স্টেশনে যাওয়ার পথসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকায় লাইটিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই নেই। তার ওপর রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী তথা রেলওয়ে পুলিশ না থাকার সুযোগে স্টেশনগুলোর বখাটেদের নিরাপদ আস্থানায় পরিণত হয়েছে। এতে সন্ধ্যার পর হরহামেশাই ঘটছে যাত্রীসাধারণের ওপর হামলাসহ ছিনতাইয়ের ঘটনা। চকরিয়া রেল স্টেশনের সার্বিক এই চিত্র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্টেশন মাস্টার মো. ফরহাদ চৌধুরী।

ঢাকাচট্টগ্রামকক্সবাজার রেললাইন দিয়ে নিয়মিত যাতায়াতকারী যাত্রী বদরখালীর রবিউল আলম, পশ্চিম বড় ভেওলার নুরুল আমিনসহ যাত্রীদের অভিযোগবহুল প্রতিক্ষিত এই রেল লাইনের অধীন চকরিয়ার স্টেশনগুলোতে নিরাপত্তার অভাবে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এমনকি অপরাধীরা যেভাবে স্টেশনগুলোতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে যাত্রীসাধারণকে।

চট্টগ্রাম শহরে কর্মরত এক নারী ব্যাংকার ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরার জন্য সাহারবিল স্টেশনে যান। এর পরপরই কয়েকজনের ছিনতাইকারী চক্র ছোঁ মেরে ভ্যানিটি ব্যাগটি নিয়ে চম্পট দেয়। এ সময় ওই নারী ব্যাংকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ছিনিয়ে নেওয়া ওই ভ্যানিটি ব্যাগে নগদ টাকা, মূল্যবান মালামাল ছাড়াও ব্যাংকের চাবি ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রাদি ছিল। এখন সেই ডকুমেন্ট ও মালামাল উদ্ধারে আমি আইনশৃক্সখলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। কিন্তু এতদিনেও কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি তিনি।

যাত্রীদের দাবি, চট্টগ্রামগামী সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনে যাতায়াতের জন্য চকরিয়া স্টেশনে আগত যাত্রীদের সংঘবদ্ধ ডাকাতছিনতাইকারী চক্রের কাছে হামলার শিকার হতে হচ্ছে। এ সময় স্টেশনে আগত যাত্রীদের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র ঠেকিয়ে মোবাইল, নগদ অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিচ্ছে। আর তাদের কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে নিশ্চিত হামলার শিকার হতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম শহরে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী ও চকরিয়ায় পূর্ব বড় ভেওলার বাসিন্দা হিমেল মাহমুদও এমন অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, শহরে ফেরার উদ্দেশে সম্প্রতি সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে চকরিয়া রেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলাম। স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে মাত্র কয়েক গজ দূরত্বে কালভার্টের পাশে এসেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ি। চারপাঁচজন যুবক হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। তারা কাঁধের ব্যাগসহ আমার কাছে যা আছে সব দিয়ে দিতে বলে। নাহয় ছুরি মেরে নাড়িভুঁড়ি বের করে দেবে বলেও হুমকি দেয়। এসময় তাদের একজনের হাতে চকচক করে উঠে ধারালো চাকু। সেদিন খুব কৌশলে তাদের হাত থেকে বেঁচে ফিরলেও সবার ভাগ্যে এমনটি ঘটে না।

জানা গেছে, বহুল প্রতিক্ষিত এই রেললাইন স্থাপন পরবর্তী যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, রামু, সদর, ঈদগাঁওসহ কক্সবাজার জেলা এবং পাবর্ত্য বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়িসহ আশপাশের উপজেলাগুলোর মানুষ নিরাপদ বাহন হিসেবে রেলে যাতায়াত শুরু করেন। এতে স্টেশনগুলোতে দিন দিন চাপ বাড়ছে যাত্রীদের।

রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চকরিয়া উপজেলাটি এমন জায়গায় অবস্থিত যার চতুর্পাশে বেশ কয়েকটি উপজেলা বিদ্যমান। তাই এসব উপজেলার মানুষেরা চকরিয়া রেল স্টেশন হয়েই সারাদেশে যাতায়াত করছেন। সেই বিবেচনায় যাত্রীদের সুবিধার জন্য চকরিয়ায় তিনটি রেল স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো হলোউত্তর প্রান্তে হারবাং ও দক্ষিণ প্রান্তে ডুলাহাজারা স্টেশন আর মধ্যখানে চকরিয়ামহেশখালী সড়কের পাশে চকরিয়া স্টেশনটি মাতারবাড়ি কয়লা বিদুৎ সড়কের সাথে সংযুক্ত থাকায় এই স্টেশনটি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এই অবস্থায় চকরিয়া স্টেশনে যাত্রীর চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা।

চকরিয়া রেল স্টেশন মাস্টারের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রেল লাইনটি চালু হওয়ার পরেও রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের নিরাপত্তায় স্থায়ীভাবে রেল পুলিশ নিয়োগ দেয়নি। এমনকি স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে এখানো হস্তান্তর করেনি। এতে আগত যাত্রীসাধারণ চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়ছেন প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয়, স্টেশনটিতে যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার থাকলেও ভেতরে নেই কোনো বসার ব্যবস্থা, নেই কোনো পরিছন্নতা কর্মীও। এতে যাত্রীদের টয়লেটসহ স্টেশনটি অপরিছন্নও হয়ে পড়ছে।

অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠার পর রেল স্টেশনগুলো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জানিয়ে চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, রেল স্টেশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিজস্ব বাহিনী তথা রেলওয়ে পুলিশ রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে চকরিয়া স্টেশনগুলোতে এখনো রেল পুলিশ নিয়োগ না দেওয়ায় বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে থানা পুলিশকে। যদিওবা রেল স্টেশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা থানা পুলিশের কাজ না হলেও প্রতিদিন একটি করে থানা পুলিশের টহল টিম প্রেরণ করতে হচ্ছে। যাতে রেলে ভ্রমণকারী যাত্রীসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, আধুনিক মানের রেললাইন ও আইকনিক স্টেশনের আদলে তৈরি রেল স্টেশনগুলোতে প্রতিনিয়ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়া খুবই দুঃখজনক। স্টেশনগুলোতে যাত্রীসাধারণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে সংযোগ সড়কগুলোতে পর্যাপ্ত লাইটিং, নিয়মিত রেলওয়ে পুলিশের টহল ব্যবস্থা জোরদার, সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ জরুরি সহায়তা সেল চালু করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃষ্টি উপেক্ষা করে মোহছেন আউলিয়ার (রহ.) ওরশে ভক্তদের ঢল
পরবর্তী নিবন্ধসুস্থ, সবল ও তামাকমুক্ত সমাজ গঠনের বার্তা নিয়ে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক ম্যারাথন