বছরের পর বছর ধরে দেশে যান–পরিবহন দুর্ঘটনা যেভাবে প্রতিনিয়ত প্রাণ নিধনের দুর্বিষহ প্রতিযোগিতায় নেমেছে; পুরো জাতি এতে চরম বিচলিত–আশঙ্কাগ্রস্ত। ঘর থেকে বেরোনোর সময় কেন যেন এক অজানা মৃত্যু ভয় ছায়ার মতো মনের অগোচরে বাসা বেঁধে চলছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি–বেসরকারি সংস্থার প্রাণপণ প্রচেষ্টায়ও এর পরিত্রাণে কার্যকর কোনো সুফল দৃশ্যমান নয়। ফলশ্রুতিতে সড়ক–মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যচ্ছে না। দোষারোপের তর্জনী ইঙ্গিতে সঙ্কট দূরীভূত হওয়ার পরিবর্তে আরও যেন ভয়াবহতায় প্রতিফলিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার ছোট–বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বিআরটিএ’র হিসাবে প্রতিদিন সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জন প্রাণ হারায়। সে হিসাবেও বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮০০ জন। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বছরে ১২ হাজার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০ হাজার মানুষ প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ : লিডারশিপ প্রায়রিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার আনেকাংশেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যায় ১০২ জন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভুটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এ সংখ্যা যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৭০, ১৩, ৪০ ও ৭ জন। যদিও বাংলাদেশে প্রতি হাজারে যানবাহন আছে মাত্র ১৮ জনের। ভারতে এ সংখ্যা ১৫৯, নেপালে ৮১, ভুটানে ১০৯ ও শীলঙ্কায় ৩২৭। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের দুর্ঘটনায় গড়ে ২ জন সাইকেল চালকের মৃত্যু হয়। দুই বা তিন চাকার মোটরযানের ক্ষেত্রে এর সংখ্যা ১১ দশমিক ২০, গাড়ি ও হালকা যানের ক্ষেত্রে ১৩ দশমিক ৩০ জন গাড়ি চালক ও ২৮ দশমিক ৬০ জন যাত্রী। আবার ট্রাক চালকদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৬ দশমিক ১০, বাস চালকদের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ২০ বাস যাত্রীর সংখ্যা ২৮৬ দশমিক ৬০ জন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাঙ্কিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। ৬১ দশমিক ৯০ শতাংশ মৃত্যু হার নিয়ে সবচেয়ে অনিরাপদ রাস্তার তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে জিম্বাবুয়ে। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার ২ দশমিক ৩১ শতাংশ হার নিয়ে সর্বাপেক্ষা নিরাপদ সড়কের তালিকায় শীর্ষে আছে সুইডেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ দেশের জিডিপির ৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৯৩ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটছে বিশ্বের মোট সড়ক যানের ৬০ শতাংশ থাকা স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর হিসাব মতে, দেশে বছরে ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারর ভাষ্য, এ মৃত্যুর সংখ্যা ২১ হাজারের বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা সেন্টারের তথ্যমতে, দেশে বছরে ১১ হাজারের মতো লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে থাকে।
৪ জানুয়ারি ২০২৫ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ২০২৩ সাল অপেক্ষা গত বছরে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ও আহতের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২৪ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৬ হাজার ৯৭৪টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে ৯ হাজার ২৩৭ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ১৯০ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৮ হাজার ৫৪৩ এবং আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৬০৮ জন। রেলপথে ৪৯৭টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ৩১৫ জন। নৌপথে ১১৮টি দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত, ২৬৭ জন আহত এবং ১৫৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনা ও জনসচেতনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান মতে, ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে নারী ৮৯৩ ও শিশু ১ হাজার ১৫২ জন। এসব দুর্ঘটনায় ছিল ১ হাজার ৫৩৫ জন পথচারী, ৯৮৪ জন বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও সহকারী, বাসযাত্রী ৩৬৯ জন, পণ্যবাহী যানবাহনের আরোহী ৪৯৯, প্রাইভেটকার–মাইক্রোবাস–অ্যাম্বুলেন্স–জীপ আরোহী ৩৬৩, থ্রি–হুইলার (ইজিবাইক–সিএনজি–অটোরিক্সা–অটোভ্যান ইত্যাদি) যাত্রী ১ হাজার ৩৯২, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন–করিমন–ভটভটি–আলমসাধু–মাহিন্দ্র–টমটম) ৩৩১ এবং বাইসাইকেল–প্যাডেল রিক্সা আরোহী ১৯৬ জন। উল্লেখ্য বছরের দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের ক্ষতি হয়েছে ২১ হাজার ৮৮৬ কোটি ৩২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। দুর্ঘটনা পর্যালোচনায় সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কের দৈর্ঘ ২২ হাজার ৪৭৬ দশমিক ২৮ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়ক প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার। এসব সড়কে নানা প্রকার যানবাহন যেমন বেড়েছে, তেমনি যানবাহনের গতিও বেড়েছে। ৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত গতি। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই। যানবাহনের গতি ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটারের উপরে প্রতি ৫ কিলোমিটার বৃদ্ধিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বৃদ্ধি পায়।
এতে আরও বলা হয়, বেপরোয়া গতির কারণে এক্সপ্রেসওয়েগুলো অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে ওঠেছে। মহাসড়কে বিকল হওয়া পণ্যবাহী যানবাহনকে বেপরোয়া গতির অপর যানবাহন পেছন দিকে ধাক্কা দিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিপতিত হচ্ছে। ২০২৪ সালে এধরনের ৮২টি ঘটনা ঘটেছে। সড়কে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্মিত উঁচু স্পিড ব্রেকারের কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালে সংঘটিত দুর্ঘটনার ৬২ শতাংশের কারণ যানবাহনের বেপরোয়া গতি বলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের অপর প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়েছে। সারা দেশের গ্রামীণ জনপদে সড়ক নির্মিত হলেও আধুনিক–নিরাপদ যানবাহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই প্রয়োজনের তাগিদেই ইজিবাইক, অটোরিঙা, নসিমন, ভটভটি, আলমসাধুর মত অনিরাপদ যানবাহনের প্রচলন ঘটেছে। সড়ক পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের দাবি, দীর্ঘ সময় এই খাতে কয়েকটি সমস্যা বিরাজমান থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। আইন হলেও তার কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় বাস্তব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। দেশের পুরো সড়ক ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা রয়েছে।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন সংস্থা–মহল কর্তৃক চিহ্নিত কারণগুলো হচ্ছে– চালকের অসাবধানতা–অদক্ষতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, রাস্তার স্বল্পতা–অপ্রশস্ততা, মহাসড়কে স্বল্প গতির যানবাহনের চলাচল, প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিং, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ট্র্রাফিক আইন ভঙ্গ করা, রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার না থাকা, ওভারব্রিজের স্বল্পতা, সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা, ফুটপাত হকারদের দখলে থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়কের উপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা, যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পথ অবরোধ–সভা ও হরতালসহ প্রভৃতি কারণে সৃষ্ট যানজটে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হওয়া, সড়ক পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত সংস্থা–প্রতিষ্ঠান সমূহের সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা ইত্যাদি। সার্বিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, সড়ক দুর্ঘটনা থেকে সক্রিয় পরিত্রাণের জন্য উল্লেখিত সমস্যা সমাধানে আশু–স্বল্প–দীর্ঘমেয়াদী বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ আইনি–সচেতনতামূলক গণপ্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী