হেপাটাইটিস বৈজ্ঞানিক নাম। ডাক্তারি পরিভাষায় হেপা- অর্থ লিভার আর টাইটিস- প্রদাহ। অর্থাৎ লিভারের প্রদাহ/রোগ। ‘হেপাটাইটিস ভাইরাস জনিত লিভারের রোগ। এই রোগটির কথা মনে আসলে প্রথমেই স্মরণ করতে হয় এই রোগের আবিষ্কারক সংক্ষেপে ‘ড. ব্লুমবার্গের’ নাম। নোবেল জয়ী এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনকে স্মরণ করে ২০১১ সাল থেকে প্রতিবৎসর ২৮ জুলাই ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস’ দিবস পালিত হয়। তিনি তাঁর সহকারীদের নিয়ে ১৯৬৫ সালে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের আদিবাসি এবোরিজিনদের রক্তে হেপাটাইটিস ‘বি’- ভাইরাসের সারফেস অ্যান্টিজেন HBs Ag আবিষ্কার করেন। তখন সবে মাত্র ইলেকট্রনমাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃত হয়। একই সাথে তিনি এই রোগের উন্নত পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন ও টিকাকরণ শুরু করেন। লিভার মানব দেহের পেটের উপরিভাগে ডানপাশে থাকে। লিভারকে বলা হয় একটি জটিল রাসায়নিক কারখানা। যেহেতু সমস্ত খাদ্য দ্রব্য যা আমরা খাই বা ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করি – বিশেষ করে খাদ্য-পরিপাক তন্ত্রে হজম ও শোষণের পর রক্তের মাধ্যমে লিভারে সঞ্চালিত হয় এবং প্রক্রিয়াজাত হয়। এরপর ঐগুলো মানব দেহের কোষ গুলোর ব্যবহারে উপযোগী হয়। এক কথায় লিভারকে পাওয়ার হাউজ বলা হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কেনো কারণে অচল হলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে না। এ ছাড়াও শরীরের উৎপাদিত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ লিভার বিশুদ্ধ করে এবং পরবর্তীতে শরীর থেকে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে। লিভারের রোগ জন্মগত থেকে শুরু করে বহুবিধ কারণে হতে পারে। হেপাটাইটিস ভাইরাস জনিত রোগ। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে হাজার লক্ষ কোটি ভাইরাস বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে। তাদের নিয়েই আমাদের বসবাস। কিছু আবিষ্কৃত হয় আর অনেক অনাবিষ্কৃত থাকে। ভাইরাস হলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মহাশক্তিশালী রোগ জীবাণু যেটা অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিধর। কারণ এটি সারা বিশ্বকে আক্রান্ত করতে পারে। যেমন- করোনা ভাইরাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাটম বোম জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিকে শুধু ধ্বংস করেছিল। কিন্তু করোনা সারা পৃথিবীকে তছনছ করে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এখনও এর তাণ্ডব শেষ হয়নি। হেপাটাইটিস ভাইরাস গুলো হলো- এ,বি,সি,ই এবং ডি। এই ভাইরাস জনিত রোগ দুই ভাগে ভাগ করা যায় ১। হেপাটাইটিস এ ও ই- খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায় ২। হেপাটাইটিস বি,সি ও ডি দূষিত রক্ত এবং সিরিঞ্জের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। আবার আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসলেও হয়। সিরিঞ্জের মাধ্যমে যারা নেশা করে তাদের বেশি হয়। বাংলাদেশ অন্যতম ঘনবসতি পূর্ণ দেশ। লোকের জীবন মান- নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্তও মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেশি-নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্য সচেনতা খুব কম। অশিক্ষার কারণে এরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার খায়। পুষ্টিকর খাদ্য খেতে পারে না। এতে এদের শরীরে ‘বি’ ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। সেলুন, হাটে বাজারে একই রেজার, ব্লেড, ক্ষুর একাধিক ব্যক্তিকে ব্যবহারের ফলে মানুষ এই রোগের শিকার হতে পারে। আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে নবজাতকের হেপাটাইটিস সি ও বি সংক্রমণ হতে পারে। টাট্টু, নাক কান ফুটো করার সময়ও আক্রান্ত হতে পারে। যৌন কর্মের দ্বারা ও সংক্রমিত হতে পারে। আমাদের দেশে খুব পরিচিত লিভারের রোগ হলো প্রথম জন্ডিস, ২। লিভার সিরোসিস, ৩। লিভার ফোরা, ৪। পিত্ত থলি ও নলির পাথর এবং ৫। লিভার ক্যানসার। এই রোগ নীরব ঘাতক। লিভার ৫০% আক্রান্ত না হাওয়া পর্যন্ত রোগী কাহিল হয় না। আর সি-ভাইরাস তুষের আগুনের মতো লিভার কোষকে পুড়ে পুড়ে ছাঁই করে দেয়। যেমন সিরোসিস অব লিভার- পেটে পানি এসে যায়। ৫-১০ বৎসর কোনো লক্ষণ থাকে না। যেহেতু এই রোগের ভ্যাকসিন নেই- এটা এইডস থেকেও মারাত্মক। আমাদের দেশে প্রতি ১০০ জন লিভার রোগীর ২-৩ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগ নিয়ে অনেক দিন বেঁচে থাকে। হেপাটাইটিস ‘বি’- ভাইরাস যেটা সব চেয়ে আলোচিত- বিশ্বময় হেপাটাইটিস ‘বি’ ইনফেকশন বিদ্যমান এবং আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক। দীর্ঘমেয়াদী ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ক্রনিক হেপাটাইটিসে এবং লিভার ক্যান্সারে ভোগে তাদের সংখ্যা ১৫-৪০%। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ কোনো না কোনো সময় ‘বি’- ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এক বছরের কম বয়সে বি-ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ থাকে। প্রাপ্ত বয়স্কদের থাকে ১০-১৫ বৎসর। প্রতি বছর সারা বিশ্বে পাঁচ লাখের উপর এই রোগের জটিলতায় মারা যায়। বি-ভাইরাস লিভার কোষে ঢুকে বংশ বৃদ্ধি করে। তার দেহে নি:সৃত HBs Ag নির্গত করে আমাদের ইম্যিউন সিস্টেম এন্টি HBs Ag তৈরি করে। আক্রান্ত রোগীর রক্তে ১-২ সপ্তাহের মধ্যে HBs Ag পাওয়া যায়। যারা কিডনি রোগী- ডাইয়ালাইসিসে আছে তাদের প্রতিবছর এ রোগের পরীক্ষা করা উচিৎ। দেশে লিভারে ক্যান্সারে আক্রান্ত শতকরা ৭০জন রোগী হেপাটাইটিস জনিত রোগে ভুগে। ন্যাশনাল লিভর ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ গবেষণায় দেখা গেছে লিভার ক্যান্সার বিশ্বে এবং বাংলাদেশে ক্যান্সার জনিত মৃত্যুর ৩য় প্রধান কারণ। লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ হেপাটাইটিস সোসাইটর এক গবেষণায় বলা হয়েছে জন্ডিস নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৭৬% হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। এই জন্ডিস রোগের সংখ্যা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে অদূর ভবিষ্যতে মহামারি আকারে দেখা দিবে। আল্ট্রাসনোগ্রাফী রিপোটে প্রায় ফ্যাটি লিভারের কথা লিখা থাকে। এটা নন অ্যালকহোলিক ফ্যাটি লিভার। এটা ‘সি’ ভাইরাসের কারণে হতে পারে। ভেজাল তেল, পুরোনো তেলে ভাজা, অপরিচ্ছন্ন খাবার, প্রচুর ফ্যাট জাতীয় খাবার, জ্যাং ফুট এর জন্য দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ প্রতিরোধ যোগ্য রোগ। একমাত্র ভ্যাকসিনেশন ও সচেতনতার মাধ্যমে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ভ্যাকসিনে ৯০-৯৫% লোকের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। বি- ভাইরাসের টিকা দেশে সর্বত্রই পাওয়া যায়। এখন মুখে খাওয়ার ওষুধ ও ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন শুধু ব্যাপক প্রচারণার দরকার। প্রচরণার মাধ্যমে জনগণকে বোঝাতে হবে হেপাটাইটিস কী? কীভাবে এটি মানব দেহে ছড়ায়। মানুষের মধ্যে এখনও সচেতনতাবোধ গড়ে ওঠেনি। কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে সাধারণ মানুষ ঝাঁর, ফোঁক পানি পড়া, মিকচার খেয়ে সারাতে চায়। এখনও মানুষ ভ্যাকসিনে আগ্রহী নয়। এখানে সরকারের ভূমিকা আছে। বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করা ও বিনামূল্যে এবং সহজ প্রাপ্যে ভ্যাকসিনেশনের ব্যবস্থা করা উচিৎ।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।